কিছু ভাঙা মোম ও কলম দেখিয়ে পিয়ের বলে উঠল, এ কাজ তোমরা করেছ? আমি তোমাদের ভালোবাসতাম, কিন্তু আরাকচিভ আদেশ পাঠিয়েছেন, যারা এগিয়ে আসবে তাদের প্রথম জনকে আমি হত্যা কর। ছোট্ট নিকলাস পিয়েরের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, কিন্তু পিয়ের সেখানে নেই। তার জায়গায় এসেছে তার বাবা-প্রিন্স আন্দ্রু-বাবার কোনো আকার নেই, গঠন নেই, তবু সে আছে, সেটা বুঝতে পেরে নিকলাস ভালোবাসায় দুর্বল হয়ে পড়ল :মনে হল সে নিজেও শক্তিহীন, পঙ্গু, নিরাকার। বাবা তাকে আদর করল, করুণা করল। কিন্তু নিকলাস কাকা ক্রমেই তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। নিকলাস ভয় পেল। তার ঘুম ভেঙে গেল।
আমার বাবা! নিকলাস ভাবল। (বাড়িতে প্রিন্স আন্দ্রুর দুখানা প্রতিকৃতি থাকলেও নিকলাস কখনো তাকে মানুষের রূপে কল্পনা করেনি।) বাবা আমার কাছে এসেছে, আমাকে আদর করেছে। আমার ও পিয়ের কাকার কাজকে সমর্থন করেছে। সে আমাকে যা করতে বলবে আমি তাই করব। মিউসিয়াস স্কাভোলা তার হাতটা পুড়িয়েছিল। আমার বেলায়ও কেন সেই একই ঘটনা ঘটবে না? আমি জানি তারা চায় আমি লেখাপড়া শিখি। শিখবই তো। কিন্তু একদিন তো লেখাপড়া শেষ হবে, আর তখন তো আমাকে কিছু না কিছু করতেই হবে। ঈশ্বরের কাছে আমার কেবল একটি প্রার্থনা, পুতার্কের চরিত্রগুলোর মতো আমার বেলায়ও কিছু ঘটুক, তাহলে আমিও তাদের মতোই কাজ করতে পারব। আরো ভালো কাজ করব। সকলেই আমাকে চিনবে, ভালোবাসবে, আমাকে দেখে আনন্দ পাবে। আর তখনই তার বুকটা দুলে উঠল, সে কাঁদতে লাগল।
তোমার কি অসুখ করেছে? তার কানে এল দেসালেসের গলা।
না, বলে নিকলাস আবার বালিশে মাথা রাখল। দেসালেস সম্পর্কে ভাবল, তিনি খুব ভালো, দয়ালু, আমিও তাকে ভালোবাসি! কিন্তু পিয়ের কাকা! আঃ, কী এক আশ্চর্য মানুষ! আর আমার বাবা? আহা, বাবা, আমার বাবা! হ্যাঁ, আমি এমন কিছু করব যাতে বাবাও খুশি হবে…
.
.
দ্বিতীয় পরিশিষ্ট
অধ্যায়-১
ইতিহাস নানা জাতি ও মানবতার জীবনস্বরূপ। মানবতার জীবন, এমন কি একটিমাত্র জাতির জীবনকে আয়ত্তে এনে তাকে ভাষা দেওয়া, তাকে বর্ণনা করা স্বভাবতই অসম্ভব কাজ।
জনগণের যে জীবন স্পষ্টতই মরীচিকাসম তাকে করায়ত্ত করে বর্ণনা করার একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে সব প্রাচীন ইতিহাসকাররা। তারা বর্ণনা করেছে জনগণের শাসক ব্যক্তিবিশেষের কর্মধারাকে, আর সেই সব মানুষের কাজকেই তারা সমগ্র জাতির কাজ বলে ধরে নিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল : সেইসব ব্যক্তি নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করতে এক একটা জাতিকে প্ররোচিত করেছে কীভাবে, আর এইসব ব্যক্তির ইচ্ছাই বা পরিচালিত হয়েছিল কিসের দ্বারা? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্রাচীনকালের মানুষরা ঐশ্বরিক শক্তির অবতারণা করেছে : সেই শক্তিই একদিকে একটা জাতিকে করেছে একজন নির্বাচিত মানুষের ইচ্ছার বশীভূত, আবার অন্যদিকে সেই নির্বাচিত মানুষের ইচ্ছাকে এমনভাবে পরিচালিত করেছে যাতে কোনো পূর্বনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে।
মানবিক ব্যাপারে দেবতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের দ্বারাই প্রাচীনরা এইসব প্রশ্নের মীমাংসা করেছে। আধুনিক ইতিহাস নীতিগতভাবে এই দুই মতবাদকেই বাতিল করে দিয়েছে। মনে হওয়া স্বাভাবিক যে মানুষের উপর দেবতার কর্তৃত্ব এবং বিভিন্ন জাতির কোনো পূর্বনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত হওয়া প্রাচীন মানুষদের এই উভয়বিধ বিশ্বাসকে বাতিল করার পরে আধুনিক ইতিহাস পর্যালোচনা করবে শক্তির বহিঃপ্রকাশকে নয়, তার কারণকে। কিন্তু আধুনিক ইতিহাস তা করেনি। নীতির দিক থেকে প্রাচীনদের মতকে বাতিল করলেও কার্যত তাকেই তারা অনুসরণ করে চলেছে। ঐশ্বরিক কর্তৃত্বসম্পন্ন এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে পরিচালিত মানুষের পরিবর্তে আধুনিক ইতিহাস আমাদের দিয়েছে হয় অসাধারণ, অতিমানিবিক ক্ষমতার অধিকারী নায়কদের, আর না হয়তো নরপতি থেকে সাংবাদিক পর্যন্ত এমন সব সাধারণ মানুষদের যারা জনতাকে পরিচালিত করে। আগেকার দিনের ইহুদি, গ্রিক, বা রোমক জাতির যেসব ঈশ্বরনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে প্রাচীন ইতিহাসকাররা মানবজাতির প্রতীক বলে মনে করত, তার পরিবর্তে আধুনিক ইতিহাস তুলে ধরেছে তার নিজস্ব উদ্দেশ্যকে–সে উদ্দেশ্য ফরাসি, জার্মান, অথবা ইংরেজ জাতির কল্যাণ, অথবা সর্বোচ্চক্ষেত্রে মানবজাতির কল্যাণ ও সভ্যতা, অবশ্য সে মানবজাতি বলতে সাধারণত বোঝায় একটি বৃহৎ মহাদেশের উত্তর-পশ্চিমের একটি ক্ষুদ্র অংশের দখলদার মানুষের কল্যাণ ও সভ্যতাকে। আধুনিক ইতিহাস প্রাচীন মানুষদের বিশ্বাসকে বাতিল করেছে, কিন্তু তার জায়গায় কোনো নতুন ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠা করেনি, এবং তার ফলে নতুন ইতিহাসকাররা অন্য পথে সেই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হয়েছে, অর্থাৎ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে (১) ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা পরিচালিত জাতি এবং (২) এমন একটি পূর্বজ্ঞাত উদ্দেশ্যের অস্তিত্ব যার দিকে এগিয়ে চলেছে এইসব জাতি ও মানব সমাজ।
গিবন থেকে বাকল পর্যন্ত আধুনিক ইতিহাসকারদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যতই অমিল থাকুক, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে যতই নতুনত্ব থাকু, তাদের সকলের লেখার ভিত্তি হিসেবে রয়েছে ওই দুটি প্রাচীন ও অনিবার্য ধারণা।