.
অধ্যায়-১৬
নাতাশা ও পিয়ের নিজেদের মধ্যে যেভাবে কথা বলতে শুরু করল তা একমাত্র স্বামী-স্ত্রীই বলতে পারে। বড় বড় চোখ তুলে নাতাশা স্বামীর দিকে এগিয়ে গেল, তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলে উঠল : এখন তুমি সম্পূর্ণ আমার, আমার! তোমাকে আর পালাতে দেব না!–আর সেইমুহূর্ত থেকে যে সংলাপ শুরু হল তা কোনো যুক্তি মানে না, বুঝি বা নিজেকেও মানে না, আপন বেগে আপনি উৎসারিত হয়ে চলে, পরস্পর পরস্পরকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে।
নাতাশা পিয়েরকে বলল তার দাদার জীবন ও কাজকর্মের কথা, তার অনুপস্থিতিতে সে যে কত কষ্ট পেয়েছে, সে যে মারিকে কত ভালোবাসে, মারি যে তার তুলনায় অনেক ভালো–এমনি সব কথা। নাতাশা যে তার চাইতে অনেক বড় সেকথা আন্তরিকভাবেই স্বীকার করলেও সে কিন্তু পিয়েরের কাছে এ দাবিও সেইসঙ্গে রাখল যে পিয়েরকে কিন্তু মারি এবং অন্য সব মেয়ের চাইতে তাকেই বেশি ভালোবাসতে হবে, বিশেষ করে এখন পিটার্সবুর্গে অনেক নারী দেখে আসার পর সেকথা তাকে অতি অবশ্য নতুন করে ঘোষণা করতে হবে।
নাতাশার কথার জবাবে পিয়ের বলল, এবার পিটার্সবুর্গে গিয়ে ডিনারে ও বলনাচের আসরে মহিলাদের সঙ্গে মেলামেশা করাটা তার কাছে বড়ই অসহ্য লেগেছে।
বলল, মেয়েদের কথা বলার কায়দাই ভুলে গেছি। সব কেমন একঘেয়ে লাগত। তাছাড়া, আমি খুব ব্যস্তও ছিলাম।
নাতাশা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল : মারি চমৎকার মেয়ে! ছেলেমেয়েদের কথা খুব ভালো বুঝতে পারে। মনে হয় সে যেন তাদের মনের ভিতরটা পর্যন্ত দেখতে পায়। ধর না গতকাল মিতা দুষ্টুমি করছিল…
পিয়ের বাধা দিয়ে বলল, ঠিক তার বাবার মতো।
নাতাশা হঠাৎ চুপ করে গেল। একটু পরে বলল, আমি এতক্ষণ কি ভাবছিলাম জান? প্লাতন কারায়েভের কথা।
পিয়ের উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, ওঃ, প্লাতন কারাতায়েভ? আমাদের পারিবারিক জীবনটা দেখলে সে খুব খুশি হতে। সবকিছুর মধ্যেই সে দেখতে চায় মিল, সুখ, তাকে এনে আমাদের জীবনটা দেখাতে পারলে আমি গর্ববোধ করতাম। ভালো কথা–তুমি তো কেবলই আমার অনুপস্থিতির কথা বলছ, কিন্তু তুমি কি বিশ্বাস করবে এই বিরহের পরে তোমাকে এখন কত বেশি ভালো লাগছে…
হ্যাঁ, আমার ভাবা উচিত… নাতাশা বলতে শুরু করল।
না, সেকথা নয়। তোমাকে না ভালোবেসে আমি পারি না। আমার মতো এমন ভালোবাসতেও কেউ পারে, কিন্তু এটা একটা বিশেষ ব্যাপার…সত্যি বলছি, অবশ্য-পিয়ের কথাটা শেষ করল না। কারণ চার চোখের মিলনেই বাকিটা বলা হয়ে গেল।
নাতাশা হঠাৎ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, এই যেসব মধুচন্দ্রিকা নিয়ে এত হৈ-চৈ, প্রথমেই নাকি জীবনের যত মধুমাস,–এসবের কোনো মানে হয়! বরং এখনই তো সবচেয়ে সেরা সময়। শুধু তুমি দূরে চলে না যাও! তোমার মনে পড়ে, আমরা কত ঝগড়া করতাম? আর সব সময়ই দোষ ছিল আমার। সবসময়। আর কি নিয়ে যে ঝগড়া করতাম-তাও ছাই মনে পড়ে না!
পিয়ের হেসে বলল, কারণ তো একটাই…ঈর্ষা…
ওকথা বল না! আমি সইতে পারি না। তার চোখে আগুনের ঝিলিক। একটু থেমে বলল, তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
না। আর হলেও আমি তাকেই চিনতেই পারতাম না।
কিছুক্ষণ দুজনই চুপ।
যে মেঘ জমেছিল তাদের মনে সেটাকে উড়িয়ে দিতে নাতাশা বলতে আরম্ভ করল, আরে জান? তুমি যখন পড়ার ঘরে কথা বলছিলে তখন আমি তোমাকেই দেখছিলাম। তোমরা যেন এক বোটায় দুটো ফল–তুমি আর তোমার ছেলে।… ও হো, এবার আমাকে যেতে হবে। ওটাকে দুধ খাওয়াতে হবে।…তোমাকে ফেলে যেতে কষ্ট হচ্ছে।
কয়েক সেকেন্ড দুজন আবার চুপ। তারপর একই সঙ্গে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একই সময় দুজন কথা বলতে শুরু করল। পিয়েরের মুখে তৃপ্তির হাসি, নাতাশার মুখে খুশির শান্ত হাসি।
না, তুমি কি যেন বলছিলে? বলে যাও
না, তুমি বল, আমার যত সব বাজে কথা, নাতাশা বলল।
পিয়ের যেকথা বলতে শুরু করেছিল শেষ করল। পিটাসবুর্গে নিজের সাফল্যের কথাই বলল।
আমি শুধু বলতে চেয়েছি, যেসব চিন্তা-ভাবনা থেকে মহৎ ফসল ফলে আসলে সেগুলো খুব সরল, সহজ। আমার বক্তব্যের সার কথাই হল, পাপীরা যদি সংঘবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, তাহলে সৎ লোকদেরও তাই করতে হবে। এটা তো খুব সোজা কথা।
ঠিক।
আর তুমি কি বলছিলে?
আমি? যত বাজে কথা।
তবু?
আরো উজ্জ্বল হাসি হেসে নাতাশা বলল, আহা, অতিতুচ্ছ কথা। আমি বলতে চেয়েছি পেতয়ার কথা: আজ যখন নার্স তাকে আমার কাছ থেকে নিতে এল, তখন সে হেসে চোখ বুজল, আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি জানি, সে লুকোতে চাইছিল। কী মিষ্টি! ওই যে, আবার কাঁদছে। আচ্ছা, চলি। নাতাশা বেরিয়ে গেল।
এদিকে একতলায় ছোট্ট নিকলাস বলকনস্কির শোবার ঘরে একটা ছোট বাতি যথারীতি জ্বলছে। (ছেলেটি অন্ধকারকে ভয় পায়, সে ভয় কিছুতেই যাচ্ছে না।) দেসালেস ঘুমোয় চারটি বালিশে ভর দিয়ে, তার রোমক নাক থেকে সুরেলা শব্দ বের হতে থাকে। ছোট নিকলাস ঘামে ভিজে সবে ঘুম থেকে উঠেছে। বিছানায় বসে হাঁ করে সামনে তাকিয়ে আছে। ঘুম ভেঙেছে একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখেছে, সে আর পিয়ের কাকা পুতার্কের বর্ণনামতো শিরস্ত্রাণ পরে একটা মস্ত বড় সেনাবাহিনীকে পরিচালিত করছে। হেমন্তের বাতাসে যেসব মাকড়শার জাল ভেসে বেড়ায় তারই মতো কাৎ হয়ে চলেছে সেনাদল। সম্মুখে গৌরব, সেটা মাকড়শার জালের মতো হলেও আরো বেশি ঘন। সে ও পিয়ের ধীরে ধীরে লক্ষ্যস্থলের দিকে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ জালের সুতোগুলো জড়িয়ে গেল, এগিয়ে চলা হল শক্ত। নিকলাস খুড়ো কঠিন, ভয়ঙ্কর মূর্তিতে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।