বেলোভো উপহারগুলির প্রশংসা করল, তার পোশাকের কাপড় পেয়েও খুশি হল।
তারপর সকলে মিলে সামোভারকে ঘিরে চায়ের টেবিলে বসল। পিয়ের একে একে কাউন্টেসের সব প্রশ্নের জবাব দিতে লাগল–প্রিন্স ভাসিলি বুড়ো হয়ে গেছে কি না, কাউন্টেস মারি আলেক্সিনা তাকে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে কি না, তাছাড়া আরো এমন সব প্রশ্ন করতে লাগল যাতে কারো কোনো আগ্রহ নেই, এমন কি এসব প্রশ্নের কথা সে নিজেও আর ভাবে না।
কথায় কথায় দেনিসভের আগ্রহে যুদ্ধের কথা, রাজনীতির কথা উঠল। বুড়ি কাউন্টেস সেসব আলোচনার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে উঠে গেল। ওদিকে পাশের ঘরে ছেলেমেয়েদের ও নাতাশার হৈ-হল্লা শুনে তাদের তদারকি করতে পিয়েরও চলে গেল।
.
অধ্যায়-১৪
কিছুক্ষণ পরে ছেলেমেয়েরা ঘরে ঢুকল শুভরাত্রি জানাতে। তারা সকলকে চুমো খেল, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও গভর্নের্সরা অভিবাদন করল, তারপর চলে গেল। শুধু থেকে গেল ছোট্ট নিকলাস ও তার শিক্ষক। দেসালেস চুপি চুপি নিকলাসকে নিচে নেমে যেতে বলল।
নিকলাস বলকনস্কিও মৃদু স্বরে বলল, না সঁসিয়ে দেসালেস, আমি কাকিমাকে বলছি আমাকে এখানে তাকার অনুমতি দিতে।
কাকিমার কাছে গিয়ে বলল, মা তাঁতে, দয়া করে আমাকে এখানে থাকতে দাও।
তার মুখে ফুটে উঠল। অনুরোধ, উত্তেজনা ও উস। তার দিকে একবার তাকিযে কাউন্টেস মারি পিয়েরের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
বলল, তুমি যতক্ষণ আছ ততক্ষণ ও এখান থেকে নড়বে না।
সুইস শিক্ষিকাটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে পিয়ের বলল, একটু পরেই ওকে আপনার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি মঁসিয়ে দেসালেস। শুভরাত্রি! তারপর নিকলাসের দিকে ফিরে বলল, আমাদের দুজনের মধ্যে তো এখনো ভালো করে দেখা সাক্ষাই হয়নি। দেখ মারি, ও কত বড় হয়ে গেছে!
আমার বাবার মতো? উজ্জ্বল উচ্ছ্বসিত চোখ মেলে পিয়েরের দিকে তাকিয়ে রক্তিম মুখে ছেলেটি শুধাল।
পিয়ের মাথা নাড়ল। তারপর আবার শুরু হল পিয়ের ও দেনিসভের আলোচনা। মারি উল বুনতে বসে গেল, নাতাশার চোখ সারাক্ষণ স্বামীর উপর। নিকলাস ও দেনিসভা উঠে পাইপ নিয়ে ধূমপান করল, সোনিয়ার কাছে থেকে আরো চা আনল। কোঁকড়া-চুল ছেলেটি সকলের অলক্ষ্যে ঘরের এককোণে বসে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরে সকলে যখন নৈশ ভোজনের জন্য উঠে পড়ল তখন ছোট্ট নিকলাস বলকনস্কি পিয়েরের কাছে গিয়ে বলল, পিয়ের কাকা, তুমি…না…আচ্ছা, বাপি বেঁচে থাকলে…সে কি তোমার সঙ্গে একমত হত?
হঠাৎ পিয়ের বুঝতে পারল, ছোট ছেলেটির উপস্থিতিতে এসব আলোচনা করা ঠিক হয়নি। কিন্তু একটা জবাব তো দিতেই হবে।
হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়, অনিচ্ছাসত্ত্বেও কথাটা বলে সে বেরিয়ে গেল।
.
অধ্যায়-১৫
ড্রেসিং-গাউন পরে নিকলাস যখন শোবার ঘরে ঢুকল, কাউন্টেস মারি তখন টেবিলে বসে কি যেন লিখছে।
কি লিখছ মারি? নিকলাস শুধাল।
কাউন্টেস মারির মুখ রাঙা হয়ে উঠল। একটা দিনপঞ্জী লিখছি নিকলাস, বলে নীল রংয়ের খাতাটি তার হাতে তুলে দিল।
দিনপঞ্জী? বল কী? একটু ঠাট্টার হাসি হেসে সে খাতাটা খুলে পাতা ওল্টাল। সত্যি, ফরাসিতে লেখা একটা দিনপঞ্জী। কাউন্টেস মারি ও ছেলেদের দৈনন্দিন জীবনের টুকিটাকি কথা লিখে রাখা হয়েছে। খানিকটা দেখে খাতাটা টেবিলে রেখে দিল।
কাউন্টেস মারি বলল, দেখ, ছোট্ট নিকলাসকে নিয়ে মাঝে-মাঝেই আমার বড় চিন্তা হয়। এরকম ছেলে সচরাচর দেখা যায় না। আমার ভয় হয়, নিজের ছেলেমেয়েদের দিকে নজর দিতে গিয়ে আমি হয় তো ওকে অবহেলা করছি। আমাদের তো সন্তান আছে, আত্মীয়-স্বজন আছে, কিন্তু ওর তো কেউ নেই। সব সময় নিজের চিন্তায়ই ডুবে থাকে।
দেখ, আমার তো মনে হয় না তার জন্য তুমি নিজেকে দোষী করতে পার। স্নেহময়ী মা তার জন্য যা কিছু করতে পারত সেসবই তো তুমি করেছে, এখনো করছ, আর সেজন্য আমিও খুব খুশি। সত্যি ছেলেটি ভালো, খুব ভালো। আজ সন্ধ্যায় তো মন্ত্রমুদ্ধের মতো পিয়েরের কথাগুলি শুনছিল। ভালো ছেলে, বড় ভালো ছেলে।
কাউন্টেস মারি বলল, তবু আমি তো তার নিজের মা নই। সেটা আমি বুঝি আর তাই তো ভয় পাই। চমৎকার ছেলে, কিন্তু তাকে নিয়ে আমার ভয়ও খুব। কিছু সঙ্গীসাথী থাকলে তার পক্ষে ভালো হত।
নিকলাস বলল, সে ব্যবস্থাও শিগগিরই হবে। পরের গ্রীষ্মকালেই আমি তাকে পিটার্সবুর্গ নিয়ে যাব।
কাউন্টেস মারি মুখে কিছু বলল না। স্বামীর হাতটা হাতে নিয়ে চুমো খেল।
ছোট্ট ভাই-পোটির কথাই ভাবতে লাগল। পিয়েরের কথাগুলি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে শুনেছে-স্বামীর এই কথাটা তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। ছেলেটির স্পর্শকাতর চরিত্রের আরো অনেক বৈশিষ্ট্যই তার মনে পড়ে গেল। তার কথা ভাবতে গিয়ে সে নিজের ছেলেমেয়েদের কথাও ভাবল। তাদের মধ্যে কোনো তুলনা সে করল না, কিন্তু তাদের প্রতি নিজের মনোভাবের সঙ্গে ছোট্ট নিকলাসের প্রতি নিজের মনোভাবকে সে তুলনা না করে পাল না, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে সে বুঝল যে ছোট্ট নিকলাসের প্রতি তার মনোভাবে কোথায় যেন কিছু ত্রুটি আছে।
অনেক সময় সে মনে করে, তাদের বয়সের জন্যই তার মনোভাবের এই পার্থক্য ঘটে, কিন্তু তবু নিজের মনে সে বোঝে যে সে অপরাধী, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, তার প্রতি সে আরো ভালো ব্যবহার করবে, অসাধ্য সাধন করবে-খৃস্ট যেভাবে মানুষকে ভালোবাসত। সেইভাবেই এ জীবনে সে ভালোবাসবে স্বামীকে, সন্তানকে, ছোট্ট নিকলাসকে, সব প্রতিবেশীকে। কাউন্টেস মারির মন সর্বদাই উড়ে চলে অনন্ত এ শাশ্বতের পানে, আর তাই কখনো শান্তি পায় না। তার মুখে ফুটে উঠল উন্নত মনের কঠিন ভাব, দেহবন্ধনে আবদ্ধ আত্মার গোপন যন্ত্রণা। নিকলাস একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। হে ঈশ্বর! সে মরে গেলে আমাদের কি হবে? তার এই মুখ দেখলেই যে সেই ভয়ই আমাকে পেয়ে বসে। এই কতা ভাবতে ভাবতে দেবমূর্তির সামনে বসে সে সান্ধ্য প্রার্থনা শুরু করল।