নিশ্চয় এক আর্শিন-এর দাম এক রুবল হবে?
পিয়ের দামটা বলল।
এত সস্তা! নাতাশা মন্তব্য করল। মেয়েরা কী খুশিই না হবে! আর মাও! শুধু আমার জন্য এটা আনলেও পারতে। মুক্তোবসানো সোনার চিরুনিটার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলল।
পিয়ের জবাব দিল, এডেলই তো লোভ দেখাল: সেই তো বারবার এটা কিনতে বলল।
সেটাকে চুলে গুঁজে দিয়ে নাতাশা বলল, কখন পরব এটা? ছোট্ট মাশাকে নিয়ে যখন সমাজে যাব তখন? হয় তো তখন আবার এটাই ফ্যাশন হয়ে উঠবে। আচ্ছা, এবার চল।
উপহারের জিনিসগুলো গুছিয়ে নিয়ে তারা প্রথমে নার্সারিতে ও পরে বুড়ি কাউন্টেসের ঘরে গেল।
কাউন্টেস সঙ্গী বেলোভাকে নিয়ে যথারীতি গ্র্যান্ড পেশেন্স খেলতে বসেছে। বগলে পার্শেলগুলো নিয়ে পিয়ের ও নাতাশা ঘরে ঢুকল। কাউন্টেসের বয়স তখন ষাটের উপর, সব চুল পাকা, মাথার কুঁচিবসানো টুপিতে মুখটাই প্রায় ঢেকে গেছে। মুখে ভাঁজ পড়েছে, উপরের ঠোঁটটা ঝুলে পড়েছে, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে।
পর পর ছেলে ও স্বামীর মৃত্যুতে তার মনে হয়েছিল আকস্মিকভাবেই এ জগৎ তাকে ভুলে গেছে, বেঁচে থাকার সব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই গেছে হারিয়ে। সে খায়, পান করে, ঘুমোয়, জেগে থাকে, কিন্তু ঠিক বেঁচে থাকে না। জীবনে কোনো নতুন ছাপ আঁকা পড়ে না। জীবনের কাছে সে শান্তি ছাড়া আর কিছু চায় না, একমাত্র মৃত্যু দিতে পারে সে শান্তি। কিন্তু মৃত্যু যতদিন না আসে ততদিন তো তাকে বেঁচে থাকতেই হবে, অথবা সব জৈব শক্তিকেই ব্যবহার করতে হবে। শরীরের বিভিন্ন যন্ত্রকে কাজ করানো ছাড়া তার জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। তাকে খেতে হয়, ঘুমতে হয়, চিন্তা করতে হয়, কথা বলতে হয়, কাঁদতে হয়, কাজ করতে হয়, রাগ দেখাতে হয়, আরও অনেক কিছু করতে হয় শুধু এই কারণে যে-তার পাকস্থলী আছে, মস্তিষ্ক আছে, স্নায়ুতন্তু আছে, একটি যকৃৎ আছে। সে কথা বলে যেহেতু তার জিভ ও ফুসফুসের অনুশীলন করা দরকার। ছোট শিশুর মতোই সে কাঁদে যেহেতু তার নাকটা পরিষ্কার হওয়া দরকার, ইত্যাদি। একটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কাছে যে কাজ উদ্দেশ্যপূর্ণ, তার কাছে সেটা একটা অছিলামাত্র।
যেমন, আগের দিন যদি একটু ভারি খাওয়া হয়ে যায় তো সকালে তার রাগ করা দরকার হয়ে পড়ে, আর সেজন্য অছিলা হিসেবে সে বেছে নেয় বেলোভার বধিরতাকে।
ঘরের এক কোণ থেকে নিচু গলায় তাকে কিছু বলতে শুরু করে।
হয়তো বলে, আজ দিনটা একটু গরম মনে হচ্ছে সোনা।
বেলোভা জবাব দিল, ঠিক, ঠিক, তারা এসেছে। কাউন্টেসও রেগে বলল, হায় প্রভু! মেয়েটা কি বোবা আর কালা!
আর একটা অছিলা তার নস্য-সেটা হয় বেশি শুকনো, নয় তো বেশি ভেজা, আর নয় তো ভালো গুড়ো হয় না। এইসব বিরক্তি প্রকাশের পরে তার মুখটা হলদে হয়ে যায়। বেলোভা আবার কখন কালা হবে, নস্য ভেজা হবে, আর কাউন্টেসের মুখ হলদে হবে, দাসীরা সেটা অভ্রান্তভাবেই বুঝতে পারে।
বৃদ্ধার এই অবস্থা সংসারের সকলেই বোঝে, কিন্তু মুখে কেউ বলে না, সাধ্যমতো তার সব প্রয়োজন মেটাতে চেষ্টা করে। শুধু নিকলাস, পিয়ের, নাতাশা ও কাউন্টেস মারির মধ্যে বিষণ্ণ হাসির সঙ্গে দুএকবার দৃষ্টি বিনিময়ের ভিতর দিয়েই প্রকাশ পায় যে তারা বৃদ্ধার অবস্থাটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে।
কিন্তু সে দৃষ্টি আরো অনেক কিছুই প্রকাশ করে : বুঝি বলে, তার জীবনে যা করণীয় ছিল তা সে করেছে, আজ তাকে যা দেখছি সেটাই তার সমগ্র রূপ নয়, একদিন আমরা সকলেই তার মতো হব, তাই তার সব খেয়াল হাসিমুখে মেনে নিয়েছি, একদিন যে ছিল পরম মূল্যবান, তাদের মতোই জীবন-শক্তিতে পরিপূর্ণ আর তাই করুণার যোগ্য তার জন্য নিজেদের সংযত করেছি। সে দৃষ্টি যেন বলে, একদিন তো আমরা সকলেই মরব।
শুধু এ সংসারে যারা সত্যি হৃদয়হীন, যারা নির্বোধ, আর যারা একেবারেই শিশু, তারাই একথাটা বুঝতে পারে না, আর তাই তাকে এড়িয়ে চলে।
.
অধ্যায়-১৩
পিয়ের ও তার স্ত্রী যখন বৈঠকখানায় ঢুকল কাউন্টেস তখন মানসিক অনুশীলনের প্রয়োজনে যথারীতি পেশেন্স খেলায় ব্যস্ত ছিল। স্বভাবসিদ্ধভাবেই সে তাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, অনেকদিন পরে সোনা, অনেকদিন পরে! তোমার জন্য অপেক্ষা করে করে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তবু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! উপহারগুলি পেয়ে আবার সেই একই পুরোনো মন্তব্য করল, উপহারটার তো দাম নয়, আসলে দামি হল তুমি যে আমার কাছে ফিরে এসেছ সেটাই, আমি তো বুড়ো হয়েছি…। মুখে কথাগুলি বললেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে সেইমুহূর্তে পিয়েরকে দেখে কাউন্টেস খুশি হয়নি, কারণ তার ফলে অসমাপ্ত খেলায় বাধা পড়েছে।
পেশেন্স খেলা শেষ করে তবে সে উপহারগুলি ভালো করে দেখতে লাগল। খুব ভালো জাতের এক বাক্স তাস, উজ্জ্বল নীল রংয়ের একটা সেভ্রে চায়ের কাপ–তার উপর মেষপালিকার ছবি আঁকা ও একটা ঢাকনা দেওয়া–আর একটা নস্যের কৌটো, তার উপর ভালো কারিগর দিয়ে কউন্টেসের ছবি খোদাই করে আঁকা। এরকম একটা কৌটো কাউন্টেসের অনেকদিনের ইচ্ছা, কিন্তু এখন সেকথা জানাতে তার ইচ্ছা হল না, সে তাসের বাক্সের দিকেই নজর দিল।
অন্য সবসময়ের মতোই বলল, ধন্যবাদ সোনা, তুমি আমাকে খুব খুশি করেছ। কিন্তু তুমি যে নিজেকে ফিরিয়ে এনেছ সেটাই সবচাইতে বড় কথা–কিন্তু তোমার বৌকে আচ্ছা করে বকে দিও তো, এরকমটা আমি কখনো দেখিনি। ওকে নিয়ে কি করি বল তো? তুমি চলে গেলে ও যেন পাগলের মত হয়ে যায়। কোনোদিকে নজর থাকে না, কোনো কথা মনে থাকে না…তারপর সঙ্গিনীর দিকে ফিরে বলল, দেখ আন্না তিমোফিভনা, ছেলে আমার জন্য কী সুন্দর একবাক্স তাস এনেছে।