সত্যি, কিন্তু ভাব তো…।
সেইমুহূর্তে নিকলাস ও কাউন্টেস মারি ঘরে ঢুকল। ছেলেকে হাতের উপর রেখেই পিয়ের ঝুঁকে পড়ে তাদের চুমো খেল, সব জিজ্ঞাসাবাদের জবাব দিতে লাগল। কিন্তু তার মন তখনো পড়ে আছে ছোট ছেলের দিকে।
কাউন্টেস মারি বলল, কী মিষ্টি দেখতে! আচ্ছা নিকলাস, এমন মিষ্টি মধুর মুখ কি তোমাকে টানে না? আমি তো অবাক হয়ে যাই।
ঠাণ্ডা চোখে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে নিকলাস বলল, ওসব আমার আসে না, আমি পারি না। একদলা মাংসপিণ্ড!
স্বামীকে সমর্থন করে কাউন্টেস মারি বলল, অথচ ও কিন্তু খুব স্নেহশীল পিতা, অবশ্য বাচ্চারা এক বছরের মতো বড় হলে তবে…,
নাতাশা বলল, পিয়ের কিন্তু ওদের খুব আদর-যত্ন করে। সে তো বলে তার হাতটা না কি বাচ্চাদের আসনের মতো করেই তৈরি করা হয়েছে। দেখই না।
শুধু সেজন্যই নয়… পিয়ের হঠাৎ হেসে উঠল। ছেলেকে তুলে দিল নার্সের হাতে।
.
অধ্যায়-১২
অন্য সব বড় সংসারের মতোই বল্ড হিলসেও অনেকগুলি ছোট ছোট স্বতন্ত্র জগৎ মিলেমিশে একটা বড় জগৎ গড়ে উঠেছে, যদিও প্রত্যেকেই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে চলে এবং অন্যের বৈশিষ্ট্যকেও মেনে নেয়। সুখ দুঃখের যে ঘটনাই সে বাড়িতে ঘটুক সেটা সকলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়, যদিও সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশের যার যার নিজস্ব বিশেষ কতকগুলি কারণ অবশ্যই থাকে।
যেমন ধরা যাক, পিয়েরের প্রত্যাবর্তন একটা আনন্দময় বড় রকমের ঘটনা, আর সকলেই সেটাকে সেইভাবেই গ্রহণ করেছে।
পিয়ের ফিরে আসায় চাকর-মহল খুশি হয়েছে কারণ তারা জানে যে সে উপস্থিত থাকলে নিকলাস প্রত্যহ জমিদারি দেখতে যাবে না, তার মন-মেজাজও ভালো থাকবে, তাছাড়া, উৎসব উপলক্ষে তারা ভালো ভালো উপহারও পাবে।
পিয়ের ফিরে আসায় ছোটরা ও তাদের গভর্নের্সরা খুশি হয়েছে কারণ অন্য কেউ তার মতো করে তাদের সবাইকে সামাজিক জীবনযাত্রার মধ্যে টেনে আনে না। একমাত্র সেই ক্ল্যাভিকর্ডে সেরকম একোসাসের সুর বাজাতে পারে যার সঙ্গে সবরকম নাচই নাচা যায়, তাছাড়া, তারা জানে তাদের সকলের জন্যই সে নানা উপহার এনেছে।
ছোট্ট নিকলাস এখন পনেরো বছরের সুঠাম তরুণ, যেমন দেখতে সুন্দর তেমনই বুদ্ধিমান, হালকা বাদামি রঙের কোঁকড়ানো চুল, আর সুন্দর দুটি চোখ। সে খুশি হয়েছে কারণ পিয়ের কাকাকে সে খুব ভালোবাস। পিয়েরের সঙ্গে তার দেখা হয় কালে-ভদ্রে : কেউ তাকে পিয়েরকে ভালোবাসতে শেখায়ওনি। কাউন্টেস মারি তাকে বড় করে তুলেছে, সে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে নিকলাস যাতে তার স্বামীকে তার মতোই ভালোবাসে, ছোট নিকলাসও তাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সে ভালোবাসার সঙ্গে যেন একটু ঘৃণার ছোঁয়া থাকে। কিন্তু পিয়েরকে সে যেন পুজো করে। নিকলাসের মতো একজন হুজার বা নাইট হতে সে চায় না, সে চায় পিয়েরের মতো জ্ঞানী, গুণী ও দয়ালু হতে। পিয়ের কাছে এলেই তার মুখটা খুশিতে জ্বল জ্বল করে, পিয়ের তাকে কিছু বললেই তার মুখ লাল হয়ে ওঠে, দম আটকে আসে। তার সব কথা সে কান পেতে শোনে এবং পরেও তা নিয়ে অনেক ভাবে। পিয়েরের অতীত জীবন, ১৮১২-র আগেকার দুঃখের কথা (চুপি চুপি শোনা কিছু কথা থেকেই একটা অস্পষ্ট ছবি সে নিজের মনেই একে নিয়েছে), মস্কোর কাণ্ডকারখানা, বন্দি জীবন, প্লাতন কারাতায়েভ (পিয়েরের মুখ থেকে শোনা), নাতাশার প্রতি ভালোবাসা, এবং যে বাবার কথা সে মনেই করতে পারে না তার সঙ্গে পিয়েরের বন্ধুত্ব–সবকিছু মিলিয়ে তার চোখে। পিয়ের হয়ে উঠেছে একটি নায়ক ও মহাপুরুষ।
অতিথিরা পিয়েরকে স্বাগত জানিয়েছে কারণ সে সর্বদাই যে কোনো মজলিসকে প্রাণবন্ত ও সংঘবদ্ধ করে তুলতে সাহায্য করে।
স্ত্রী ছাড়াও পরিবারের অন্য সব বড়রাও এমন একজন বন্ধুকে ফিরে পেয়ে খুশি হয়েছে যে কাছে থাকলে জীবনযাত্রা আরো স্বচ্ছন্দ ও শান্তিময় হয়ে ওঠে।
বাড়ির বুড়িরা উপহার পেয়েই খুশি, বিশেষত এবার নাতাশা আবার আগেকার মতো হয়ে উঠবে।
এইসব আলাদা জগতের আলাদা মনোভাব পিয়ের ভালোই বাসে, সেইভাবেই সে তাদের সকলেরই বাসনা পূর্ণ করেছে। পূর্বেকার ব্যয়বহুল ব্যবস্থা মতোই পারিবারিক জীবন শুরু করার সময় থেকেই পিয়ের সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে যে আগেকার তুলনায় এখন তার ব্যয় হয় অর্ধেক, অথচ প্রধানত প্রথমা স্ত্রীর ঋণের দরুন সংসারে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তারও অনেক উন্নতি দেখা দিয়েছে।
জীবনযাত্রা সীমিত বলেই তার ব্যয়ও এখন আগের তুলনায় কম : সেই ব্যয়বহুল বিলাসিতা, সে ধরনের জীবনযাত্রা তো যে কোনো মুহূর্তে বদলানো যায়, এখন আর সেভাবে সে জীবন চালায় না, চালাতে চায় না। সে বোঝে, বর্তমান জীবনযাত্রা মৃত্যুর দিন অবধি পাকাপাকিভাবে স্থির হয়ে গেছে, তার কোনো পরিবর্তন করা তার সাধ্যায়ত্ত নয়, এই জীবনযাত্রাই অল্প ব্যয়সাধ্য।
হাসিমুখে পিয়ের জিনিসপত্রগুলি সাজিয়ে রাখছিল।
দোকানির মতো করে একটা কাপড়েরর বাজ খুলতে খুলতে বলল, এটা কেমন হয়েছে বল তো?
বড় মেয়েটিকে কোলে নিয়ে নাতাশা সামনেই বসেছিল, স্বামীর উপর থেকে কাপড়টার দিকে চোখ ফিরিয়ে। বলল, বেলোভার জন্য তো? চমৎকার! হাত দিয়ে কাপড়টা দেখল।