একপক্ষকালের বেশি হয়ে গেল সে ছুটি ফুরিয়েছে। ফলে নাতাশ সবসময়ই ভয়ে ভয়ে থাকে, কেমন যেন মন-মরা, বিরক্ত ভাব।
সেই পক্ষকালের মধ্যেই এসে হাজির হল দেনিসভ। সে এখন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল, বর্তমান বিধিব্যবস্থায় খুবই অসন্তুষ্ঠ। নাতাশাকে দেখে তার মনে যুগপৎ দেখা দিল দুঃখ ও বিস্ময়। ক্লান্ত বিষণ্ণ দৃষ্টি, কাদাচিৎ কথার জবাব দেয়, সবসময়ই নার্সারির কথা বলে। একদিন যে তার মনকে ভুলিয়েছিল আজ এই তার স্বরূপ!
নাতাশা সারাক্ষণ মন-মরা ও খিটখিটে হয়ে থাকে, বিশেষ করে যখন মা, দাদা, সোনিয়া, অথবা কাউন্টেস মারি তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে পিয়েরের কাজকে সমর্থন করে, তার ফিরতে বিলম্ব হবার কৈফিয়ৎ দেয়।
যে কাজকে সে কিছুদিন আগেই খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করত তার সম্পর্কেই এখন বলে, যত সব বাজে, অর্থহীন কাজ–এসব আলোচনার কোনো শেষ নেই–যত সব বাজে সমিতি!
একমাত্র ছেলে পেতয়াকে আদর করতে সে নার্সারিতে চলে যায়। আর কেউই এই তিন বছরের প্রাণীটির মতো করে তাকে সান্ত্বনার বাণী শোনাতে পারে না-যুক্তিপূর্ণ কথাও বলতে পারে না। সেই প্রাণীটি যেন বলে, তুমি রাগ করেছ, তোমার মনে ঈর্ষা জেগেছে, তুমি ভয় পেয়েছ-কিন্তু আমি তো আছি! আর আমিই সেই…।
একথার কোনো জবাব নেই। এ তো সত্যের চাইতেও সত্য।
এই দুশ্চিন্তা-ভরা একটা পক্ষকাল নাতাশা ছোট্ট প্রাণীটিকে নিয়ে এত বেশি মাতামাতি করল যে তার ফলে তাকে মাত্রাতিরিক্ত খাওয়াল, সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। ছেলের অসুখ দেখে সে ভীষণ ভয় পেল, অথচ, এটাই তার দরকার ছিল। তাকে সেবাযত্ন করতে পেয়ে স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তা সহ্য করা তার পক্ষে সহজতর হল।
বাচ্চাটার সেবাযত্ন করতে করতেই সামনের ফটকে সে পিয়েরের স্লেজের শব্দ শুনতে পেল। বুড়ি নার্স সুখবরটি নিয়ে হাসিমুখে দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকল।
পাছে ছেলের ঘুম ভেঙে যায় তাই কোনোরকম নড়াচড়া না করে নাতাশা ফিসফিস করে শুধাল, সে কি এসেছে?
নার্সও ফিসফিস করে জবাব দিল, তিনি এসেছেন মাম। নাতাশার মুখে রক্ত উঠে এল, আপনা থেকেই চলতে চাইল পা, কিন্তু সে লাফিয়ে ছুটে যেতে পারল না। বাচ্চাটি আবার চোখ মেলে তার দিকে তাকাল। যেন বলতে চাইল, তুমি এখানে? তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁট চাটতে লাগল।
সাবধানে মাই টেনে নিয়ে নাতাশা তাকে একটু দোলা দিল, তারপর তাকে নার্সের হাতে তুলে দিয়ে দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি ছেলেকে ছেড়ে আসায় বিবেকের তাড়নায়ই যেন দরজায় থেমে পিছন ফিরে তাকাল। নার্স ছেলেকে খাটের রেলিংয়ের উপরে তুলে ধরেছে।
হেসে নিচু গলায় বলল, আপনি যান মাম! কোনো চিন্তা করবেন না, যান!
নাতাশা হাল্কা পা ফেলে ছুটে গেল বাইরের ঘরের দিকে।
পাইপ মুখে দিয়ে দেনিসভ পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল নাচ-ঘরে, আর তখনই প্রথম বারের মতো চিনতে পারল পুরোনো দিনের নাতাশাকে। তার পরিবর্তিত মুখ থেকে উৎসারিত হচ্ছে উজ্জ্বল সানন্দ আলোর বন্যা।
পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে নাতাশা বলছে, সে এসেছে, পিয়ের ফিরে এসেছে বুঝতে পেরে দেনিসভও খুশি হয়ে উঠল। ঝুল-বারান্দায় পৌঁছে নাতাশা দেখল, লোমের কোট গায়ে একটি দীর্ঘদেহী পুরুষ গলার স্কার্ফটা খুলছে। ওই তো সে! সত্যি সে! সে এসেছে! বলতে বলতে নাতাশা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল, তার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল, তারপর তাকে সরিয়ে দিয়ে তার রক্তিম খুশি-খুশি মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, সত্যি সে, যেমন সুখী তেমনই সন্তুষ্ট…
তখনই সহসা তার মনে পড়ে গেল গত একপক্ষকালের উদ্বেগ ও যন্ত্রণার কথা, মুখ থেকে নিভে গেল খুশির আললা, চোখ কুঁচকে উঠল, ক্রুদ্ধ তিরস্কার বর্ষণ করে পিয়েরকে বিব্রত করে তুলল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালো কাজ করেছ। তোমার তো মজা, সুখে দিন কাটিয়েছ.. কিন্তু আমার কি হাল? অন্তত ছেলেমেয়েদের কথাও তো ভাবা উচিত ছিল। আমার এই অবস্থা, বুকের দুধ নষ্ট হয়ে গেছে,…পেতয়া মরতে বসেছিল। আর তুমি সেখানে ফুর্তি করছিলে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফুর্তি…
পিয়ের জানে তার কোনো দোষ নেই, আরো আগে আসা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, সে জানে এই বকবকানি আরো দু এক মিনিট চলবে, আরো জানে যে সে নিজে বেশ খুশিই আছে। হাসতে চাইল, কিন্তু সাহসে কুলোল না। করুণ-করুণ মুখ করে ঝুঁকে দাঁড়াল।
সত্যি বলছি, এর আগে আসার উপায় ছিল না। কিন্তু পেতয়া কেমন আছে?
এখন ভালো আছে। এস! তোমার লজ্জা হচ্ছে না দেখে আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি! তোমাকে ছাড়া আমি যে কেমন হয়ে গিয়েছিলাম, কত কষ্ট পেয়েছি, তা যদি নিজের চোখে দেখতে!
এখন ভালো আছ তো?
পিয়েরের হাত ধরে টেনে নাতাশা বলল, চল, চল। তারা নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়াল।
নিকলাস ও তার স্ত্রী যখন পিয়েরকে দেখতে এল সে তখন নার্সারিতে ছোট ছেলেকে হাতে নিয়ে নাচাচ্ছে। ছেলেটির ফোকলা মুখে স্বর্গীয় হাসির ছটা। ঝড় অনেকক্ষণ থেমে গেছে, নাতাশার মুখে তখন খুশির উজ্জ্বল আলোর ঝিকিমিকি, মমতাভরা চোখে সে স্বামী ও পুত্রের দিকে তাকিয়ে আছে।
শুধাল, প্রিন্স থিয়োডোরের সঙ্গে সব কথা আলোচনা করেছ তো?
হ্যাঁ, চমৎকার আলোচনা হয়েছে।
আচ্ছা, প্রিন্সেসের সঙ্গে দেখা হয়েছে? একথা কি সত্যি যে সে ভালোবেসেছে…