কয়েক মিনিট পরেই কাউন্টেস মারি ঘরে ঢুকে বলল, সে এসেছে। আহা, আমাদের নাতাশার জীবনে যেন জোয়ার এসেছে। এখন যদি তাকে দেখ! চল, চল, তাড়াতাড়ি চল। মেয়েটি বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে দেখে বলল, অনেক হয়েছে, এবার ওকে ছেড়ে দাও তো!
মেয়ের হাত ধরে নিকলাস বেরিয়ে গেল।
কাউন্টেস মারি নিজের মনেই বলে উঠল, মানুষ যে এত সুখী হতে পারে তা আমি কখনো বিশ্বাস করতে পারতাম না। মৃদু হাসিতে তার মুখখানি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, আবার সেই সঙ্গে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসও ফেলল, দুটি গভীর চোখে ফুটে উঠল শান্ত বিষণ্ণতা, যেন সুখের ভিতর দিয়েই সে অনুভব করল যে এমন আর একরকমের সুখ আছে যা এই জীবনে পাওয়া যায় না, অথচ এই মুহূর্তে আপনা থেকেই সে সুখের চিন্তা তার মনে জাগল।
.
অধ্যায়-১০
নাতাশার বিয়ে হয়েছিল ১৮১৩-র বসন্তকালের গোড়ার দিকে, ১৮২০-তেই তার তিনটি মেয়ে হয়েছে, তাছাড়া আছে অনেক আশার ধন কোলের ছেলেটি। নাতাশা আরো শক্তসমর্থ হয়েছে, মোটা হয়েছে, আজকের স্বাস্থ্যবতী জননী নাতাশার মধ্যে সেদিনের সেই তম্বী তরুণী নাতাশাকে চেনাই শক্ত। দেহ-রেখা আগের চাইতে স্পষ্টতর হয়েছে, মুখে দেখা দিয়েছে একটা প্রশান্ত, গম্ভীর ভাব। মুখের সেই উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, রমণীয় ভাবটা আর নেই। তার দেহ ও মুখ এখন নেহাই গতানুগতিক, আত্মার সাক্ষাৎ সেখানে কদাচিৎ মেলে। চোখে পড়ে শুধু একটি স্বাস্থ্যবতী, সুন্দরী, উর্বরা নারীমূর্তি। মুখে সেদিনের সেই কনক-দীপ্তি কৃচিৎ কখনো জ্বলে ওঠে, আর তখন সে যেন আগেকার চাইতেও মনোরমা হয়ে ওঠে।
বিয়ের পর থেকে নাতাশা ও তার স্বামী মস্কোতে, পিটার্সবুর্গে, মস্কোর নিকটবর্তী জমিদারিতে, অথবা নাতাশার মার কাছে অর্থাৎ নিকলাসের বাড়িতেই থেকেছে। তরুণী কাউন্টেস বেজুখভা সমাজে বড় একটা যাতায়াত করে না, আর গেলেও সেখানকার লোকজন তাকে নিয়ে খুশি নয়, তাদের চোখে সে মনোরমাও নয়, সৌজন্যপূর্ণও নয়। নাতাশা যে একলা থাকাই পছন্দ করে তা কিন্তু নয়, কিন্তু গর্ভিনী অবস্থা, সন্তানের জন্ম, তাদরে লালন-পালন ও স্বামীকে সঙ্গ দানে তার এত বেশি সময় কেটে যায় যে সমাজে যাবার সময়ই হয় না। বিয়ের আগে যারা নাতাশাকে চিনত তারা তো তার এই পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে যেত। একমাত্র বুড়ি কাউন্টেস মায়ের মন দিয়ে বুঝতে পারত যে নাতাশার যত কিছু হৈচৈ সবই ছিল স্বামী ও সন্তানের প্রয়োজনে, সে বলত, নাতাশা যে একদিন আদর্শ স্ত্রী ও জননী হবে তা সে আগেই জানত।
কাউন্টেস বলে, শুধু তার স্বামী-সন্তানের প্রতি ভালোবাসা সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এটাই যা সমস্যা।
কিন্তু সাধারণভাবে সমাজের ধার না ধরলেও নাতাশার কাছে তার আত্মীয়-স্বজনের সমাজ খুবই মূল্যবান-কাউন্টেস মারি ও তার দাদা, তার মা ও সোনিয়ার সঙ্গ সে খুবই পছন্দ করে। স্বামী-সন্তানকে নিয়ে নাতাশা এত বেশি বিব্রত থাকে যে তার পোশাক-পরিচ্ছদ, চুল বাঁধার ধরন, অপরকে ঈর্ষার চোখে দেখা–এসব কিছু নিয়েই সকলের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা পর্যন্ত চলত। সাধারণভাবে সকলেই মনে করে যে পিয়ের তো স্ত্রীর একেবারে হাতের মুঠোয়। কথাটা সত্যি। বিয়ের প্রথম দিনই নাতাশা তার দাবিগুলি জানিয়ে দিয়েছিল। সে বলেছিল, পিয়েরের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মালিক সে ও তার পরিবার। এই সম্পূর্ণ নতুন কথা শুনে পিয়ের তো অবাক। সে যেমন বিস্মিত হল, তেমনই আত্মতুষ্টিও বোধ করল, স্ত্রীর দাবিকে মেনেও নিল।
বাড়ির বাইরে পিয়ের স্ত্রীর নির্দেশ এত বেশি মেনে চলে যে কোনো মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করা তো দূরের কথা, হেসে কথা বলতে পর্যন্ত সাহস করে না, সখ করে কখনো ক্লাবে যেতে পারে না, খুশি মতো টাকা খরচ করতে পারে না, এবং বিশেষ কাজ ছাড়া বেশিক্ষণ বাড়ির বাইরে কাটাতে সাহস করে না। অবশ্য এর ক্ষতিপূরণস্বরূপ বাড়ির ভিতরে নিজের জীবন এবং পরিবারের সকলকে চালাবার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব পিয়ের নিজের হাতে পেয়েছে। বাড়িতে নাতাশা চলে স্বামীর ক্রীতদাসীর মতো, সে যখন লেখাপড়া কের গোটা বাড়িটা তখন পা টিপে টিপে চলে। মুখ খুলতে না খুলতেই তার আদেশ পালিত হয়। মনের বাসনা প্রকাশ করামাত্রই নাতাশা এক লাফে ছুটে গিয়ে তা পূর্ণ করে দেয়।
এইভাবে বিবাহিত জীবনের সাতটা বছর কাটাবার পরে পিয়েরের মনে এই সানন্দ অনুভূতি হল যে সে নিজে লোক খারাপ নয়, আর এই অনুভূতির কারণ স্ত্রীর মধ্যে সে নিজেকে প্রতিবিম্বিত হতে দেখেছে। মনে হল, তার মধ্যে ভালো-মন্দ দুইই ওতঃপ্রোতভাবে মিশে গেছে। কিন্তু তার মধ্যে যা কিছু ভালো তার প্রতিবিম্ব পড়েছে স্ত্রীর মধ্যে, আর যা কিছু ঠিক ভালো নয় তাই খারিজ হয়ে গেছে। আর এটা কোনো বিচার-বিবেচনার ফল নয়, একটা প্রত্যক্ষ ও রহস্যময় প্রতিফলন।
.
অধ্যায়-১১
রস্তভদের বাড়িতে থাকার সময় দুমাস আগে পিয়ের একটা চিঠি পেল প্রিন্স থিয়োডোরের কাছ থেকে, পিয়ের যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তেমন একটা সমিতিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় যোগ দিতে তাকে পিটার্সবুর্গে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
চিঠিখানা পড়ে (নাতাশা সব সময়ই স্বামীর চিঠি পড়ে থাকে) নাতাশা বলল, স্বামীর অনুপস্থিতি তার পক্ষে কষ্টদায়ক হলেও তার পিটার্সবুর্গে যাওয়া উচিত। পিয়েরের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে নাতাশা তাকে যেতেই বলল, কিন্তু সেইসঙ্গে তার ফিরে আসার একটা নির্দিষ্ট তারিখও ঠিক করে দিল। তাকে চার সপ্তাহের ছুটি দেওয়া হল।