স্ত্রীকে আর একটি কথাও না বলে সে ছোট বৈঠকখানায় গিয়ে সোফা শুয়ে পড়ল।
কাউন্টেস মারি ভাবল, সর্বদা এই তো চলেছে। আমার সঙ্গে ছাড়া আর সকলের সঙ্গেই ও কথা বলে বুঝেছি…বুঝেছি, ওর কাছে আমি বিরক্তিকর হয়ে উঠেছি, বিশেষ করে আমার এই অবস্থায়। সে একবার তাকাল নিজের স্ফীত উদরের দিকে, আবার আয়নায় তাকাল নিজের ফ্যকাসে, শুকনো মুখের দিকে, চোখ দুটো আগে চাইতে অনেক বড় দেখাচ্ছে।
তার কাছে সবকিছুই বিরক্তিকর বোধ হচ্ছে-দেনিসভের চিৎকার ও উচ্চহাসি, নাতাশার কথা, বিশেষ করে সোনিয়ার বাকা চাউনি।
কিছুক্ষণ অতিথিদের সঙ্গে বসে থেকে কাউন্টেস মারি নিঃশব্দে সেখান থেকে বেরিয়ে নার্সারিতে গেল।
ছেলেমেয়েরা চেয়ার দিয়ে গাড়ি বানিয়ে মস্কো যাওয়া খেলছে, মাকেও তাদের সঙ্গে যোগ দিতে ডাকল কিছুক্ষণ বসে তাদের সঙ্গে খেলা করল, কিন্তু স্বামীর কথা, তার অকারণ রাগের কথা মনে করে চিন্তিত হল উঠে দাঁড়িয়ে পা টিপে টিপে ছোট বৈঠকখানার দিকে গেল। নিজেকে বলল, হয়তো সে ঘুমোয়নি, তার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে হবে। বড় ছেলে ছোট্ট আন্দ্রু মাকে নকল করে পা টিপে তাকে অনুসরণ করল। খেয়ালই করল না। বড় বৈঠকখানায় তার সঙ্গে দেখা হতেই সোনিয়া বলল, সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে মারি–তাকে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আন্দ্রু হয়তো তাকে জাগিয়ে তুলবে।
কাউন্টেস মারি মুখ ঘুরিয়ে তাকাল, দেখল ছোট্ট আন্দ্রু পিছন পিছন আসছে, বুঝল যে সোনিয়া ঠিক বলেছে। সঙ্গে সঙ্গে তা মুখ লাল হয়ে উঠল, কিন্তু কোনো কড়া কথা উচ্চারণ করল না। সোনিয়াকে কিছু। বলে ইশারায় আন্দ্রুকে চুপি-চুপি আসতে বলে সে দরজার কাছে গেল। সোনিয়া অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল নিকলাস যে ঘরে ঘুমিয়েছিল সে ঘর থেকে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ আসছে। সে শব্দ স্ত্রীর কাছে খুবই পরিচিত শুনতে শুনতেই সে যেন চোখের সামনে দেখতে পেল স্বামীর মসৃণ, সুন্দর কপাল, তার গোঁফ, তার সমস্ত মুখে ঘুমের মধ্যে রাতের নিস্তব্ধ প্রহরে সেসব সে অনেকবার দেখেছে। হঠাৎ নিকলাস নড়েচড়ে গলা খাঁকারি দিল আর সঙ্গে সঙ্গে ছোট আ দরজার বাইরে থেকে বলে উঠল, বাপি! মামণি এখানে দাঁড়িয়ে আছে। কাউন্টেস মারি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে ছেলেকে ইশারা করল। সে চুপ করে গেল। মুহূর্তের নীরবতা। সে নীরবতা কাউন্টেস মারির কাছে ভয়ঙ্কর। সে জানে, ঘুম ভাঙানোটা নিকলাস খুব অপছন্দ করে। আবার নিকলাসের গলা পরিষ্কার করার ও নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেল। সে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, একমুহূর্তও শান্তিতে থাকতে পারি না। মারি, তুমি কি ওখানে? কেন ওকে এখানে এনেছ?
আমি শুধু তোমাকে দেখতে এসেছিলাম, খেয়াল করিনি…তুমি আমাকে ক্ষমা কর…।
নিকলাস কাশল। আর কিছু বলল না। কাউন্টেস মারি দরজা থেকে সরে এসে ছেলেকে নিয়ে নার্সারিতে ফিরে গেল। পাঁচ মিনিট পরে বাবার আদরের মেয়ে তিন বছরের কৃষ্ণাঙ্গী নাতাশা যখন দাদার কাছে শুনল যে বাপি ঘুমচ্ছে আর মা আছে বৈঠকখানায় তখন সে মার অলক্ষ্যে একদৌড়ে বাবার কাছে চলে গেল। কালো চোখের ছোট মেয়েটি সাহস করে দরজাটা সশব্দে খুলে ফেলল, ছোট ঘোট পা ফেলে সোফার কাছে এগিয়ে গেল, বাবা তার দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমিয়েছিল, নাতাশা পা টিপে এগিয়ে গিয়ে বাবার মাথার নিচেকার হাতে চুমো খেল। মৃদু হেসে নিকলাস মুখ ফেরাল।
দরজায় শোনা গেল কাউন্টেস মারির ভয়ার্ত চাপা কণ্ঠস্বর, নাতাশা! নাতাশা! বাপি এখন ঘুমবে।
ছোট্ট নাতাশা জোর দিয়ে বলল, না মামণি, বাপি এখন ঘুমবে না। সে তো হাসছে।
নিকলাস উঠে বসল, মেয়েকে কোলে তুলে নিল। স্ত্রীকে বলল, ভিতরে এস মারি।
ভিতরে ঢুকে সে স্বামীর পাশে বসল। সভয়ে বলল, আমি বুঝতে পারিনি, যে ছেলেটা আমার পিছু পিছু আসছিল। তোমার ঘরে একটু উঁকি দিয়েছিলাম মাত্র।
ছোট মেয়েটিকে এক হাতে ধরে নিকলাস আর এক হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তার চুলে চুমো খেল।
নাতাশাকে বলল, মামণিকে একটা চুমো খাই?
নাতাশা লজ্জায় হেসে ফেলল।
নিকলাস যে জায়গাটায় চুমো খেয়েছিল সেটা ইশারায় দেখিয়ে সে ধমক দিয়ে বলল, আবার!
স্ত্রীর মনের কথা বুঝতে পেরে নিকলাস বলল, আমি তো বুঝতে পারি না কিসে তুমি জানলে যে আমি রাগ করেছি।
তুমি ওরকম ভাব দেখালে আমি যে কত দুঃখ পাই, কত একলা বোধ করি সে ধারণা তোমার নেই। আমার সব সময়ই মনে হয়…
নিকলাস হেসে বলল, বাজে কথা বলো না মারি। তোমার এজন্য লজ্জা হওয়া উচিত!
মনে হচ্ছে তুমি আমাকে ভালোবাসতে পার না, আমি এত সাদাসিধে… চিরকালই তাই… আর এখন… এই অবস্থায়…
আঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না! রূপের জন্যতো ভালোবাসা নয়, ভালোবাসাই মানুষকে সুন্দর করে। মালভিনা এবং ওই ধরনের নারীদেরই মানুষ রূপের জন্য ভালোবাসে। কিন্তু আমার স্ত্রীকে কি আমি ভালোবাসি না? যদি ভালো না বাসি, কিন্তু… কীভাবে যে বলব ঠিক বুঝতে পারছি না…
আমি জানি। তাহলে আমার উপর তুমি রাগ করোনি তো?
ভীষণ রাগ করেছি! সোফা থেকে উঠে নিকলাস হাসতে হাসতে বলল–আমি এতক্ষণ কী ভাবছিলাম জান মারি? ভাবছিলাম… পিয়েরকে বসন্তকাল পর্যন্ত থেকে যেতে বলব।
হলঘরে কার যেন পায়ের শব্দ শোনা গেল।
কেউ এসেছে।
নিশ্চয় পিয়ের। আমি দেখছি, বলে কাউন্টেস মারি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিকলাস ছোট মেয়েটিকে নিয়ে ঘরময় দাপাদাপি শুরু করে দিল। একসময় হাঁপিয়ে উঠে মেয়েকে কাঁধ থেকে নামিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। অকারণেই তার মনে হল, একদিন এই মেয়ে বড় হবে, সে বুড়ো বয়সে তাকে সমাজে নিয়ে যাবে, আর তার বাবা যেভাবে মেয়ের সঙ্গে দানিয়েল কুপার নাচত, সেও সেইভাবে এই মেয়ের সঙ্গে মাজুকা নাচবে।