একসময় বন্ধু নাতাশার সঙ্গে সোনিয়ার বিষয়ে কথা প্রসঙ্গে নিজের অবিচারের কথাই তাকে বলল।
নাতাশা বলল, কি জান, তুমি তো সুভাষিতাবলি অনেক বেশি পড়ছে–তাতে একটা অনুচ্ছেদ আছে যেটা সোনিয়ার বেলায় খুব খাটে।
কোনটা বল তো? কাউন্টেস মারি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল।
যার আছে তাকে আরো দেওয়া হবে, আর যার কিছু নেই, তার কাছ থেকে সব নেওয়া হবে। মনে পড়ে? সোনিয়া সেই মানুষ যার কিছুই নেই, কেন নেই তা আমি জানি না। হয়তো আত্মসর্বস্বতার অভাব, আমি জানি না, কিন্তু তার কাছ থেকেই নেওয়া হয়েছে, সবকিছু নেওয়া হয়েছে। অনেক সময় তার জন্য আমার খুব দুঃখ হয়। আগে আমি খুব চাইতাম যে নিকলাস তাকে বিয়ে করুক, কিন্তু সব সময়ই আমার মনে কেমন যেন একটা ধারণা ছিল যে সেটা ঘটবে না। সে এক ফলহীন ফুল, কি জান এক ধরনের স্ট্রবেরি ফুলের মতো। অনেক সময় তার জন্য আমার দুঃখ হয়, আবার অনেক সময় ভাবি, সে দুঃখকে সে তোমার-আমার মতো করে অনুভব করে না।
কাউন্টেস মারির মনে হল, সত্যি সত্যি সোনিয়া নিজের অবস্থাকে কষ্টকর বলে বলে মনে করে না, ফলহীন ফুলের ভাগ্যকেই সে মেনে নিয়েছে। সে কোনো ব্যক্তিকে ভালোবাসে না, ভালোবাসে গোটা পরিবারকে। বিড়ালের মতোই তার অনুরাগ মানুষের প্রতি নয়, বাড়ির প্রতি। সে বুড়ি কাউন্টেসের সেবা করে, ছোটদের আদার দিয়ে নষ্ট করে, ছোটখাট সেবার জন্য সদাই প্রস্তুত থাকে, আর সকলেই বিনা কৃতজ্ঞতায়ই সে সেবা গ্রহণ করে।
বল্ড হিলসে পল্লী ভবনটাকে নতুন করে গড়া হয়েছে, অবশ্য বুড়ো প্রিন্সের আমলের মতো ততটা বড় মাপে নয়। আর্থিক অসুবিধার মধ্যে অত্যন্ত সাদামাঠাভাবেই বাড়িটা তৈরি করা হয়েছে। পুরোনো পাথরের ভিতের উপর প্রকাণ্ড বাড়িটা বানানো হয়েছে কাঠ দিয়ে, তার পলস্তরা করা হয়েছে কেবল ভিতরের দিকটা। নিজস্ব ভূমিদাস ছুতোর মিস্ত্রিরাই নিজেদের বার্চ কাঠ দিয়ে বানিয়েছে খুব সাধারণ শক্ত সোফা, হাতল-চেয়ার, টেবিল ও চেয়ার। বাড়িটা বেশ বড়, তাতে পারিবারিক ভূমিদাসদের জন্য ঘর আছে, আছে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা। রস্তভদের গোটা পরিবার এবং বলকনস্কিদের আত্মীয়স্বজনরা মাঝে মাঝে বল্ড হিলসে আসে ষোলোটা ঘোড়া ও ডজনখানেক চাকর-বাকর নিয়ে, থাকে মাসের পর মাস। তাছাড়া, বছরে চারবার করে নামকরণ-দিবস ও জন্ম দিবস উপলক্ষ্যে শ খানেক অতিথি এসে দু একটা দিন কাটিয়ে যায়। বছরের বাকি সময়টা দৈনন্দিন জীবনের বাঁধা পথ ধরেই চলে, প্রাতরাশ, লাঞ্চ, ডিনার ও সাপারের ব্যবস্থা সম্পত্তির আয় থেকেই চলে যায়।
.
অধ্যায়-৯
১৮২০ সালের পাঁচই ডিসেম্বর, সেন্ট নিকলাস দিবসের সন্ধ্যা। হেমন্তের শুরু থেকেই নাতাশা স্বামী-পুত্র নিয়ে দাদার বাড়িতেই আছে। পিয়ের গেছে পিটার্সবুর্গে নিজের কাজে, বলে গেছে সেখানে তিনি সপ্তাহ থাকবে, কিন্তু প্রায় সাত সপ্তাহ কেটে গেছে, যে কোনো সময় তার ফেরার কথা।
বেজুখভ পরিবার ছাড়াও নিকলাসের প্রবীণ-বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ভাসিলি দিমিত্রিচ দেনিসভা ৫ ডিসেম্বর উপলক্ষ্যে রস্তভদের বাড়িতেই আছে।
৬ তারিখে তার নামকরণ-উৎসব। বাড়িতে তখন অনেক অতিথির সমাগম হবে। নিকলাস জানে সেদিন তাকে নতুন পোশাক পরতে হবে, যে গির্জাটি সে নিজে তৈরি করেছে সেখানে যেতে হবে, যেসব অতিথিরা তাবে অভিনন্দন জানাতে সেখানে সমবেত হবে তাদের অভ্যর্থনা করতে হবে, তাদের খানাপিনার ব্যবস্থা করতে হবে জ্বজনদের নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা বলতে হবে। সেদিনের সন্ধ্যাটা সে কিন্তু স্বাভাবিক কাজকর্ম নিয়েই কাটাতে ইচ্ছুক। করলও তাই। ডিনারের সময় সে বাড়ি ফিরে এল, স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে কথা বলার সময় না থাকায় সোজ গিয়ে বসল বিশ জনের জন্য আয়োজিত লম্বা খাবারের টেবিলে। বাড়ির সকলেই তখন সেখানে হাজির টেবিলে বসেছে তার মা, মার বান্ধবী বেলোভা, তার স্ত্রী, গভর্নেস ও শিক্ষিকাসহ তাদের তিনটি সন্তান, সোনিয়া, দেনিসভ নাতাশা ও তার তিন সন্তান, তাদের গভর্নেস, এবং স্বর্গত প্রিন্সের স্থপতি বুড়ো মাইকেল আইভানভিচ, অবস নিয়ে সে বল্ড হিলসে বাস করছে।
কাউন্টেস মারি বসেছে টেবিলের অপর প্রান্তে। স্বামীর হাবভাব দেখেই মনে হল তার মন-মেজাজ ভালে নেই। এভাবে তাকে অকারণে ক্ষুব্ধ হতে দেখে কাউন্টেস মারি মনে আঘাত পেল, দুঃখিত হল। স্বামী কোথায় গিয়েছিল সেটা জানতে চাইল। নিকলাস জবাব দিল। স্ত্রী আবার জানতে চাইল, খামারে সবকিছু ঠিক ঠিক চলছে কি না। স্ত্রীর অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বিরক্ত হয়ে সেও ভুরু কুঁকে তাড়াতাড়ি একটা জবাব দিল ।
কাউন্টেস মারি ভাবল, তাহলে আমি ভুল করিনি। কিন্তু সে আমার উপর বিরক্ত হল কেন?
দেনিসভকে ধন্যবাদ, সে আলোচনার মোড় ঘুড়িয়ে দিল, সকলে ভোলা মনে কথা বলতে শুরু করল। স্বামী স্ত্রী মধ্যে আর কোনো কথা হল না। টেবিল ছেড়ে যাবার আগে তারা যথারীতি বুড়ি কাউন্টেসকে ধন্যবাদ জানাল তারপর কাউন্টেস মারি হাত বাড়িয়ে স্বামীর হাতে চুমো খেল, জানতে চাইল, সে রাগ করেছে কেন।
নিকলাস জবাবে বলল, কী সব অদ্ভুত ধারণা যে তোমার মাথায় আসে। রাগ করার কথাই তো আমার মনে আসেনি।
নিকলাস ও তার স্ত্রীর দিনগুলি সুখেই কাটছে। তাদের সুখ দেখে মাঝে মাঝে সোনিয়া ও বুড়ি কাউন্টেসের ঈর্ষা হয়। তবু তার মধ্যেই দুজনের খিটিমিটিও বাধে। কাউন্টেস মারির গর্ভাবস্থার পর থেকেই সেটা মাঝে মাঝেই ঘটছে। খুশি মনে বেশ শুনিয়ে শুনিয়েই নিকলাস বলল, দেখুন মাননীয়া ভদ্রমহোদয়া, সকাল ছয়টা থেকে ঠায় দুপায়েই তো চলছি। কাল আবার অনেক কষ্ট আছে কপালে। সুতরাং এবার একটু বিশ্রাম চাই।