শুকনো করুণ গলায় সে শুধু বলল, বিধবা সম্রাজ্ঞীর বোনই ব্যারন ফুংকের নাম তার কাছে সুপারিশ করেছিলেন।
সম্রাজ্ঞীর নাম করতেই হঠাৎ আন্না পাভলভনার মুখে গভীর ও আন্তরিক অনুরাগ, শ্রদ্ধা ও বিষণ্ণতার একটা মিশ্র ভাব ফুটে উঠল। যতবার সে তার বিখ্যাত কত্রীর নাম উল্লেখ করে ততবারই তার মুখে এই একই ভাব ফুটে ওঠে।
প্রিন্স নীরবে বসে রইল, কেমন একটু উদাসীন ভাব। আন্না পাভলভনা তাকে সান্তনা দেবার জন্য বলল, এবার আপনার পরিবারের কথা বলুন। আপনি কি জানেন যে আপনার মেয়েকে দেখে সকলেই মুগ্ধ? সকলেই বলছে, সে তো অপূর্ব সুন্দরী।
শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য প্রিন্স মাথা নিচু করল। আমি অনেক সময়ই ভাবি, একটু চুপ করে থেকে প্রিন্সের আরো কাছে ঘেঁষে প্রসন্ন হাসি হেসে তার দিকে তাকিয়ে মহিলাটি বলতে লাগল, আমি অনেক সময়ই ভাবি, জীবনের সুখগুলিকে অনেক সময় কত। অন্যায়ভাবেই না বণ্টন করা হয়ে থাকে। ভাগ্য আপনাকেই এমন দুটি চমৎকার সন্তান উপহার দিয়েছে কেন? একেবারে হোট আনাতোলর কথা আমি বলছি না। তাকে আমি পছন্দ করি না। এমন চমৎকার দুটি সন্তান। অথচ আপনি তাদের মোটেই ভালো চোখে দেখেন না; তাই তো বলি, এমন সন্তান পাবার হক আপনার নেই।
একটি স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে।
প্রিন্স বলল, আমি কিন্তু নিরুপায়। লাভাতের হয়তো বলত, বাপ হবার মতো হিম্মৎই আমার নেই।
ঠাট্টার কথা নয়; আপনার সঙ্গে গুরুতর কথা আছে। আপনি কি জানেন, আপনার ছোট ছেলেকে নিয়ে আমি খুশি নই? নিজেদের মধ্যে বলেই বলছি, সম্রাজ্ঞীর কাছে তার কথা তোলায় তিনি আপনার জন্য দুঃখ করলেন…
প্রিন্স কোনো কথা বলল না, কিন্তু জবাবের অপেক্ষায় মহিলাটি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। প্রিন্স ভুরু কুঁচকাল।
অবশেষে বলল, আপনি আমাকে কী করতে বলেন? আপনি তো জানেন তাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য বাবার পক্ষে যা করা দরকার সে সবই আমি করেছি, কিন্তু তারা দুজনেই মূর্খ। হিপোলিৎ তো তবু শান্ত মূর্খ, কিন্তু আনাতোল তো দুরন্ত মূর্খ। দুজনের মধ্যে ওইটুকুই যা পার্থক্য। অস্বাভাবিক হাসি হেসে সে কথাগুলি বলল; ফলে তার মুখের চারদিকে যে ভাঁজ পড়ল তাতে একটা অপ্রত্যাশিত কঠোরতা ও ক্ষোভই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল।
আপনার মতো মানুষের সন্তান হয় কেন? আপনি যদি বাবা না হতেন তাহলে তো আপনার বিরুদ্ধে আমার কিছুই বলার থাকত না, চোখ তুলে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আন্না পাভলভনা বলল।
আমি আপনার অনুগত দাস, আর তাই একমাত্র আপনার স্বীকার করছি যে আমার সন্তানরাই আমার জীবনের কলঙ্ক। এ দুঃখ আমাকে বয়ে বেড়াতেই হবে। এভাবেই আমি নিজেকে বোঝাই। এর হাত থেকে রেহাই নেই।
আর কোনো কথা বলল না। একটা বিশেষ অঙ্গভঙ্গি করে নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণের ভাব প্রকাশ করল শুধু। আন্না পাভলভনা ভাবতে লাগল।
একসময় বলল, আপনার অমিতব্যয়ী ছেলে আনাতোলের বিয়ের কথা কখনো ভেবেছেন? লোকে বলে, ঘটকালি করাটা বুড়িদের একটা নেশা, যদিও নিজের মধ্যে এখনো সে দুর্বলতা আমি বোধ করি না, তবু একটি ছোট মেয়ের কথা আমি জানি যে তার বাবাকে নিয়ে খুব কষ্টে আছে। সে আপনার আত্মীয়াও বটে–প্রিন্সের মারি বল্কনস্কায়া।
প্রিন্স ভাসিলি কোনো জবাব না দিলেও সাংসারিক লোকের পক্ষে উপযুক্ত ক্ষিপ্র স্মৃতিশক্তির বশে এমনভাবে মাথা নাড়ল যাতে মনে হল যে এ খবরটা সেও ভেবে দেখছে।
অবশেষে মনের বিষণ্ণ চিন্তাস্রোতকে সংযত করতে না পেরে বলে উঠল, আপনি কি জানেন যে আনাতোলের জন্য বছরে আমার চল্লিশ হাজার রুবল খরচ হয়? আর সে যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে পাঁচ বছরে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? আর বাবাদের এ সবই সহ্য করতে হয়…। আপনার এই প্রিন্সেসটি কি ধনবতী?
তার বাবা খুব ধনী ও কঞ্জুস। গ্রামে থাকেন। তিনিই সুপরিচিত প্রিন্স বলকনস্কি; স্বৰ্গত সম্রাটের সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন; সকলে তাকে প্রাশিয়ার রাজা বলেই ডাকে। লোকটি বুদ্ধিমান, কিন্তু ছিটগ্রস্ত ও বিরক্তিকর। মেয়েটি বড়ই কষ্টে আছে। তার একটি ভাই আছে। মনে হয় তাকে আপনি চেনেন, সম্প্রতি সে লিসা মিনেনকে বিয়ে করেছে। ছেলেটি কুতুজভের এড-ডি-কং; আজ এখানে আসবে।
হঠাৎ প্রিন্স আন্না পাভলভনার হাতটা চেপে ধরে যে কারণেই হোক হাতটাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, শুনুন প্রিয় আন্নেৎ, এই ব্যবস্থাটা আপনি করে দিন, তাহলে চিরদিন আমি আপনার একান্ত বংশব্দ দাস হয়ে থাকব। মেয়েটি ধনী, বংশও ভালো, আর আমিও তাই চাই।
তারপর তার সুপরিচিত সহজ ভঙ্গিতে মহিলার হাতটি তার ঠোঁটের কাছে তুলে চুমো খেল এবং অন্য দিকে তাকিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে হাতটাকে এদিক ওদিক দোলাতে লাগল।
একটু ভেবে আন্না পাভলভনা বলল, শুনুন। আজ সন্ধ্যায়ই আমি ছোট বলকুনস্কির স্ত্রী লিসার সঙ্গে কথা বলব, আশা করি ব্যবস্থাটা হয়ে যাবে। আপনার পরিবারের পক্ষ নিয়েই আমি ঘটকালির কাজে শিক্ষানবিশী শুরু করে দেব।
*
অধ্যায় ২
আন্না পাভলভনার ড্রয়িং রুম ক্রমেই লোকজনে ভরে উঠছে। পিটার্সবুর্গের একেবারে উঁচু মহলটাই সেখানে হাজির : সমবেত লোকজনের মধ্যে বয়স ও চরিত্রের ব্যবধান পিস্তর, কিন্তু সামাজিক মর্যাদায় সকলেই এক। প্রিন্স ভাসিলির মেয়ে সুন্দরী হেলেন এসেছে তার বাবাকে দূতাবাসের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে; তার পরনে বলনাচের পোশাক, তাতে প্রধান অতিথির তকমা আঁটা। পিটার্সবুর্গের সব চাইতে মনোরমা তরুণী প্রিন্সেস বলকনস্কায়াও এসেছে। গত শীতকালে তার বিয়ে হয়েছে; সন্তানসম্ভাবনা দেখা দেয়ায় সে আজকাল বড় জমায়েতে যায় না, শুধু ছোটখাটো অনুষ্ঠানেই যোগ দেয়। প্রিন্স ভাসিলির ছেলে হিপোলিৎ এসেছে মর্তোমাকে সঙ্গে নিয়ে; তাকে সে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মঠাধ্যক্ষ মোরিও এবং আরো অনেকেই এসেছে।