প্রিয় বান্ধবী, প্রথমেই বলুন আপনি কেমন আছেন। আপনার বন্ধুর মনকে শান্ত করুন, গলার স্বরের কোনোরকম পরিবর্তন না করেই প্রিন্স বলল; আপাত ভদ্রতা ও সহানুভূতির অন্তরালে তার কণ্ঠস্বরের নিস্পৃহতা, এমনকি বিদ্রূপটাও চাপা পড়ল না।
আন্না পাভলভনা বলল, মনের মধ্যে নৈতিক যন্ত্রণা দিয়ে কেউ কি ভালো থাকতে পারে? অনুভূতির বালাই থাকলে এখনকার মতো অবস্থায় কেউ কি শান্ত হতে পারে? আশা করি সারা সন্ধ্যাটাই এখানে কাটাবেন?
আর ইংরেজ রাজদূতের ওখানকার উৎসবের কী হবে? আজ বুধবার। একবার তো আমাকে সেখানে দেখা দিতেই হবে, প্রিন্স বলল। আমাকে সেখানে নিয়ে যাবার জন্য আমার মেয়ে আসবে।
আমি ভেবেছিলাম আজকের উৎসবটা বাতিল করা হয়েছে। সত্যি বলছি, এসব উৎসব আর আতসবাজি বড়ই ক্লান্তিকর হয়ে উঠছে।
তারা যদি আপনার এই ইচ্ছাটা জানত তাহলে উৎসবটা অবশ্য বন্ধ করে দিত, প্রিন্স বলল। দম-দেয়া ঘড়ির মতো অভ্যাসবশত সে এমন সব কথা বলে যা লোকে বিশ্বাস করুক তাও সে চায় না।
ঠাট্টা করবেন না! আচ্ছা, নভসিলতসেভের কাগজপত্র সম্পর্কে কি স্থির হয়েছে? আপনি তো সবই জানেন।
তারা স্থির করেছে যে বোনাপার্ত তার নৌকাগুলি পুড়িয়ে দিয়েছে, আর আমার বিশ্বাস, আমাদের নৌকাগুলি পোড়াতেও আমরা রাজি।
প্রিন্স ভাসিলি সবসময়ই পুরনো পার্ট আওড়ানোর মতো করে টেনে টেনে কথা বলে। অপর দিকে, চল্লিশ বছর বয়স হলেও আন্না পাভলভনা শেরার উত্তেজনায় ও আবেগে টগবগ করে। সবসময় উৎসাহে ভরপুর থাকাটাই যেন তার সামাজিক কর্তব্য; আর তাই মনের অবস্থা কখনো সে রকম না থাকলেও পাছে পরিচিত জনকে হতাশ করতে হয় এই ভয়েই তাকে উৎসাহে ভরপুর থাকাটাই যেন তার সামাজিক কর্তব্য, আর তাই, মনের অবস্থা কখনো সে-রকম না থাকলেও পাছে পরিচিত জনকে হতাশ করতে হয় এই ভয়েই তাকে উৎসাহশীল হতে হয়। তার ম্লান মুখের সঙ্গে মানানসই না হলেও তার ঠোঁট দুখানিকে ঘিরে স্মিতহাসির রেখাঁটি সবসময়ই খেলা করে বেড়ায়; নিজের এই ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হলেও এটাকে সংশোধন করতে সে চায় না, সংশোধন করতে পারে না। সংশোধন করা প্রয়োজন বলেও মনে করে না।
রাজনীতিবিষয়ক আলোচনা প্রসঙ্গে আন্না পাভলভনা হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল :
আঃ, অস্ট্রিয়ার কথা আমার কাছে বলবেন না। আমি হয়তো এসব ব্যাপার বুঝি না, কিন্তু অস্ট্রিয়া কোনোদিন যুদ্ধ চায়নি, আজও চায় না। সে আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। রাশিয়া একাই ইউরোপকে বাঁচাবে। আমাদের মহামান্য সম্রাট এই মহৎ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন, আর সে কর্তব্যে তিনি অবিচলই থাকবেন। এই একটি কথা আমি বিশ্বাস করি। আমাদের সৎ ও আশ্চর্য সম্রাট এই পৃথিবীতে একটি মহৎ ভূমিকা পালন করবেন; আর তিনি এতই ধার্মিক ও মহান যে ঈশ্বর তাকে পরিত্যাগ করবেন না। তার কর্তব্য তিনি পালন করবেন, এই নরঘাতক শয়তানকে আশ্রয় করে যে সহস্ৰশীর্ষ সপ্নরূপী বিপ্লব আজ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তাকে তিনি ধ্বংস করবেন! ভালো মানুষের রক্তের প্রতিশোধ শুধু আমাদেরই নিতে হবে…। আর কার উপর আমরা নির্ভর করতে পারি শুনি? ব্যবসায়ীসুলভ মনোবৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড কখনো সম্রাট আলেক্সান্দারের মহত্ত্বকে বুঝবে না, বুঝতে পারে না। সে তো মাল্টা ছেড়ে আসতেও আপত্তি করেছে। আমাদের সব কাজের মধ্যেই তো সে একটা গোপন অভিসন্ধি খুঁজে বেড়াচ্ছে। নভসিলতসেভ কী জবাব পেয়েছে? কিচ্ছু না। আমাদের সম্রাটের আত্মত্যাগকে ইংরেজরা বুঝতে পারেনি, পারবেও না। নিজের জন্য তিনি কিছুই চান না, চান শুধু মানুষের কল্যাণ। আর তারা কী দিচ্ছে? কিছুই না! আর মুখে যেটুকু বা বলছে, কাজে তাও করছে না! প্রাশিয়া তো আগাগোড়াই বলছে, বোনাপার্ত অপরাজেয়; তার সামনে গোটা ইওরোপ অসহায়।…হার্ডেনবুর্গ বা হগউইজের কথার এক বর্ণও আমি বিশ্বাস করি না। প্রাশিয়ার এই বিখ্যাত নিরপেক্ষতা তো একটা ফাঁদমাত্র। আমার ভরসা শুধু ঈশ্বরকে, আর আমাদের পরমারাধ্য সম্রাটের মহৎ নিয়তিকে। ইওরোপকে তিনিই রক্ষা করবেন!
নিজের আবেগে হেসে উঠে মহিলাটি হঠাৎ থেমে গেল।
প্রিন্স হেসে বলল, আমার তো মনে হয়, আমাদের প্রিয় ইউজিনগেরোদের বদলে আপনাকে যদি পাঠানো হত, তাহলে আপনি হয়তো গায়ের জোরেই প্রাশিয়ার রাজার সম্মতি আদায় করে নিতে পারতেন। আপনার যা গলার জোর। এক কাপ চা কি মিলবে?
এখনই। শান্ত গলায় আবার বলল, ভালো কথা, আজ রাতে দুজন মজার লোককে আশা করছি। একজন ভাইকোঁত দ্য মর্তেমার্ত, সেরা ফরাসি পরিবার রোহাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে; একজন সত্যিকারের সৎ বিদেশী। অপরজন আবে মোরিও। সেই বিদগ্ধ চিন্তাশীল লোকটিকে আপনি চেনেন? সম্রাট তাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। শুনেছেন?
প্রিন্স বলল, তাদের সঙ্গে দেখা হলে খুশি হব। কিন্তু বলুন তো, এ কথা কি সত্যি যে বিধবা সম্রাজ্ঞী ব্যারন ফুংকে-কেই ভিয়েনাতে প্রথম সচিব নিযুক্ত করতে চাইছেন? ব্যারন লোকটি সবদিক থেকেই বড়ই বেচারি।
প্রিন্স ভাসিলির ইচ্ছা ছিল এই চাকরিটা তার ছেলে পাক, কিন্তু অন্য সকলে বিধবা ম্রাজ্ঞী মারিয়া ফিয়রভনার কাছে দরবার করছিল যাতে ব্যারনই চাকরিটা পায়।
আন্না পাভলভনা চোখ দুটো প্রায় বুজে ফেলল; যেন বোঝাতে চাইল সম্রাজ্ঞী যা ইচ্ছা করেছেন, বা যাতে খুশি হয়েছেন তা নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার তারও নেই, বা অন্য কারো নেই।