তলস্তয় তাঁর অতীতকে অস্বীকার করলেন। অভিজাত জীবনযাত্রা, তার সম্পত্তি, এমনকি তার এ যাবষ্কালের সমগ্র সাহিত্যকর্মকেও তিনি অস্বীকার করতে চাইলেন। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াল আত্মিক উত্তরণ ও মানবতার সেবা। পরবর্তীতে যে-সকল লেখা লিখেছেন তার মূল কথা হল তার একান্ত নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের অভিব্যক্তি এবং যুক্তিতর্কের অতীত এক পরম বোধের প্রকাশ।
তলস্তয়ের মনের এ পরিবর্তন এসেছিল এক প্রবহমান নিরন্তর সংগ্রামের ফলশ্রুতি হিসেবে। একদিকে ফরাসি চিন্তাবিদ রুশোর প্রভাব, অন্যদিকে রুশ কৃষকদের সরল জীবনযাত্রার প্রতি গভীর আগ্রহ তলস্তয়কে এ উপলব্ধির কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছিল। উনিশ শতকে পাশ্চাত্য জীবনযাত্রার যে ব্যাপক যন্ত্রসভ্যতার বিকাশ ঘটছিল, তলস্তয়ের সজাগ মন তার খবর রাখত। তাঁর বিশেষ ধরনের মানসিক গড়ন এ যান্ত্রিকতাকে মেনে নেয়ার অনুকূলে ছিল না। এ যান্ত্রিকতা ও কৃত্রিমতার উপর খড়গহস্ত তিনি, এমনকি, এ-বোধের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিলেন-সভ্যতা মানেই দাসত্বের শৃঙ্খল। সমাজ নিজের প্রয়োজনে এসব শৃঙ্খলা সৃষ্টি করে নিয়েছে। কাজেই সভ্যসমাজ থেকেই যাবতীয় গরল উথিত হয়ে মনুষ্যত্বকে গ্রাস করছে। এ সমাজ বেশকিছু মিথ্যা মূল্যবোধ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়ে আছে। তার ফলে মানুষের ভেতরকার খাঁটি ভালো গুণগুলো স্কুরিত হতে পারছে না। তলস্তয় মনে প্রাণে চাইলেন এসব প্রাথমিক ভালোর কাছে গভীরভাবে ফিরে যেতে। তাঁর পীড়িত বিবেক বারবার সরল সত্যকে অবলম্বন করতে চাইল। তার সামাজিক মর্যাদা আর ঐশ্বর্য তাঁকে নিরন্তর যন্ত্রণাদগ্ধ করতে লাগল। তিনি মনে করলেন, গ্রামের গরিব চাষীদের সুখ দুঃখের অংশীদার হয়ে তাদেরই মধ্যে অভিমানবিহীনভাবে বসবাস করতে পারলে জীবন যথার্থ সার্থক হয়ে উঠতে পারে। সরল গরিব চাষীদের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার মধ্যে নিহিত রয়েছে গভীর প্রজ্ঞা উপলব্ধি।
পারিবারিক জীবনের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রেখে তিনি একজন ভদ্র কৃষক হতে চাইলেন। এ সাধনা খুব সহজ ছিল না। পরিজন, বিশেষ করে স্ত্রী, এমন জীবনযাত্রা পদ্ধতিকে সহজে মেনে নিতে পারলেন না। সম্ভবও ছিল না। এর ফলে তাঁর মনে যে নিদারুণ মানসিকদ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল, তার পরিচয় সমকালীন সাহিত্যকীর্তিতে উজ্জ্বলভাবে ধরা আছে। মনের এই পর্যায় নিয়ে তলস্তয়ের প্রায় পনেরো বছর কেটেছিল। বলা যায় ১৮৮০ সালের পর থেকেই এই পর্যায়ের শুরু।
.
তলস্তয়ের জীবনে উভয়সংকট দেখা দিল। তার পক্ষে অসহ্য হল। তিনি বুঝলেন, এভাবে সময় করে সত্যকে পাওয়া সহজ নয়। তাই এবার, জীবনের শেষপর্বে চাইলেন সংসার সমাজ পরিজন সম্পদ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে মুক্ত সরল জীবনে আশ্রয় নিতে। তখন কিন্তু তাঁর পুত্রকন্যার সংখ্যা তেরা এবং অনেকেই তাদের মধ্যে সাবালক। এমনকি নিজস্ব সম্পত্তি সমস্ত বিলিয়ে দিয়ে একেবারে নিষ হতে চাইলেন তিনি। এই নিয়ে পরিবারের সকলের সঙ্গে, বিশেষ করে স্ত্রীর সঙ্গে বাঁধল তার প্রচণ্ড বিরোধ। স্ত্রী যৌবনকালে স্বামীর লেখা বৃহত্তম উপন্যাস সগ্রাম ও শান্তির পাণ্ডুলিপি অসংখ্যবার অনুলিপি করে করে দিয়েছিলেন, তিনিই স্বামীর যাবতীয় ধ্যানধারণা ও সাহিত্যকীর্তির বিরোধী হয়ে উঠলেন। মতান্তর এমন পর্যায়ে পৌঁছল যাতে সোফিয়া কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করলেন। নিজের সুকঠিন মানসিকসংকট এবং স্ত্রীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব বিরাশি বছর বয়স্ক বৃদ্ধ তলস্তয়কে বাধ্য করল ইয়াসিয়ানা ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি জমাতে। কখনো ঘোড়ার পিঠে, কখনো ট্রেনে শুরু হল তার দীর্ঘ পদযাত্রা। অবশেষে অস্তাপোডো স্টেশনে এসে আর চলতে পারলেন না। নিদারুণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। ইয়াসিয়ানায় খবর পৌঁছল। কাউন্টেস সোফিয়া পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে অখ্যাত স্টেশনে এসে পৌঁছলেন। কিন্তু তলস্তয় আর বেশিদিন পৃথিবীতে রইলেন না। কাউন্টেস ও তার পরিজনেরা এসে পৌঁছবার তিনদিন পর ১৯১০ সালের ২৩ নভেম্বর ভোরে মৃত্যু হল সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক লিও তলস্তয়ের।
যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হল ইয়াসিয়ানায়। কোনোরকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াই তাঁকে সমাহিত করা হল। ইয়াসিয়ানায় তলস্তয় স্মৃতিভবন গড়ে উঠল। ইয়াসিয়ানা পলিয়ানা আজ সোভিয়েত রাশিয়া তথা পৃথিবীর অন্যতম পবিত্রস্থান।
লিও তলস্তয়ের সমগ্র কথাসাহিত্যকে প্রবণতা অনুযায়ী মোট দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একদিকে অভিজাত শ্ৰেণীর সমারোহপূর্ণ জীবনযাত্রার অন্তরালে তীব্র বাসনা ও নৈতিক সংকট, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সহজ সরল দৈনন্দিন জীবনে পরম উপলব্ধির বিকাশ। একদিকে আনা কারেনিনা বা রেজারেকসন জাতীয় উপন্যাস এবং আফটার দ্য বল বা কুয়েৎসার সোনাটা জাতীয় গল্প, অন্যদিকে ইয়ার্ডস্টিক বা হোয়ার লাভ ইজ শ্রেণীর রচনা। এবং সর্বোপরি রয়েছে তাঁর মহত্তম কীর্তি সংগ্রাম ও শান্তি।
উপন্যাসে বর্ণিত প্রধান পরিবারসমূহ এবং অন্যান্য কয়েকটি চরিত্র।
বেজুখভ-পরিবার
কাউন্ট সিরিল বেজুখভ
পিয়ের, ঐ পুত্র, পরবর্তীকালে কাউন্ট পিতর বেজুখভ
প্রিন্সেস কাতিচে, পিয়েরের সম্পর্কিত বোন
রস্তভ-পরিবার