মারিয়া ভাসিলিয়েভনা তার অভ্যাসমতো তার (প) হাত শুধু জোরে চেপেই ধরলেন না, জোরে জোরে ঝাঁকালেন; আবার তাকে রুহিতন তাসটি খেলার ভুটা মনে করিয়ে দিয়ে এমনভাবে হাসলেন যে পোলতোরাৎস্কির কাছে তা প্রেমময় ও অর্থপূর্ণ মনে হলো।
পোলতোরাৎস্কি বাসায় ফিরল খুব উৎফুল্ল মনে। কারণটা কেবল তার মতো লোকেরাই বুঝতে পারবে। যারা উচ্চ সমাজে বড় ও শিক্ষিত হয়ে বহু মাস বিচ্ছিন্ন সামরিক জীবন কাটিয়ে তাদের নিজ শ্রেণির একজন মহিলা, তা আবার প্রিন্সেস ভরসভের মতো মহিলার সান্নিধ্য পেয়েছে।
সে এবং তার সহকর্মী যে ছোট বাড়িটায় থাকে, সেখানে পৌঁছে সে দরজায় ধাক্কা দিল, কিন্তু সেটা তালাবদ্ধ। সে দরজায় টোকা দিল, কিন্তু তারপরও সেটা খুলল না। সে বিরক্ত হয়ে দরজায় লাথি মারতে ও তলোয়ার দিয়ে ঠক ঠক করতে শুরু করল। তখন সে পায়ের শব্দ শুনতে পেল, পোলতোরাৎস্কির গৃহদাস ভভিলো দরজা আটকানোর খিলটি খুলে দিল।
নিজেকে তালা দিয়ে কী করছিলি, বলদ?
এটা কি সম্ভব, স্যার?
আবার মাতাল হয়েছিস! দেখাই তোকে কী করে সম্ভব? এবং পোলতোরাৎস্কি ভভিলোকে মারতে উদ্যত হয়েও থেমে গেল। জাহান্নামে যা! মোমবাতি জ্বালিয়ে আন।
এক মিনিট।
ভভিলো আসলেই মাতাল হয়েছিল। সে রসদ সার্জেন্টের নাম-দিবসের (যে সাধুর নামে নাম রাখা হয়, তার জন্মদিন পার্টিতে মদ খেয়েছিল। বাড়ি ফিরে সে নিজের জীবনের সঙ্গে সার্জেন্ট ইভান পেত্রোভিচের জীবনের তুলনা করছিল। ইভান পেত্রোভিচ বেতন পায়, বিবাহিত এবং বছরখানেকের মধ্যেই ছাড়া পাওয়ার আশা করছে।
ভভিলো ছেলেমানুষ থাকতেই তাকে তুলে নেওয়া হয়। তার মানে তাকে তার মালিকের বাড়ির কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এখন তার বয়স চল্লিশের ওপরে এবং জীবন কাটছে বেপরোয়া মালিকের সঙ্গে সেনাশিবিরে। মনিব হিসেবে সে ভালো, তাকে কদাচিৎ পেটায়; কিন্তু এটা কেমন জীবন? আমরা ককেশাস থেকে ফিরে গেলে সে আমাকে মুক্তি দেবে বলেছে, কিন্তু মুক্তি নিয়ে আমি যাব কোথায়? এটা একটা কুত্তার জীবন! ভভিলো ভাবছিল এবং তার এত ঘুম পেয়েছিল যে কেউ ঘরে ঢুকে কিছু চুরি করতে পারে, এই ভেবে দরজার হুড়কোটা লাগিয়ে দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
.
পোলতোরাৎস্কি তার শোবার ঘরে ঢুকল, এই ঘরে সে তিখোনভের সঙ্গে থাকে।
কী, তুমি হেরেছ? ঘুম ভেঙে তিখোনভ জিজ্ঞেস করল।
যা হয়, আমি হারিনি। আমি ১৭ রুবল জিতেছি এবং আমরা এক বোতল ক্লিকো (ভোভ ক্লিকো, শ্যাম্পেনের উদ্ভাবক এবং সবচেয়ে পরিচিত শ্যাম্পেন) খেয়েছি!
এবং তুমি মারিয়া ভাসিলিয়েভনার দিকে তাকিয়েছিলে?
হ্যাঁ, আমি মারিয়া ভাসিলিয়েভনার দিকে তাকিয়েছিলাম, নকল করে বলল পোলতোরাৎস্কি।
শিগগিরই ঘুম থেকে ওঠার সময় হবে, তিখোন বলল। আমাদের ছয়টার সময় রওনা হতে হবে।
ভভিলো! হাঁকল পোলতোরাৎস্কি, দেখ, কাল সকালে আমাকে ঠিক পাঁচটার সময় জাগিয়ে দিবি!
আপনার যদি যুদ্ধ করতে হয়, তবে আরেকজন কেন জাগাবে?
আমি তোকে বলছি আমাকে জাগাতে! শুনেছিস?
ঠিক আছে। ভভিলো বের হয়ে গেল, সঙ্গে নিয়ে গেল পোলতোরাৎস্কির বুট আর জামাকাপড়। পোলতোরাৎস্কি মুচকি হেসে বিছানায় গেল, একটা সিগারেট টানল এবং মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল। অন্ধকারে সে তার সামনে মারিয়া ভাসিলিয়েভনার হাসিমুখ দেখতে পেল।
.
ভরসভরা সঙ্গে সঙ্গে ঘুমাতে যায়নি। মেহমানেরা চলে যাওয়ার পর মারিয়া ভাসিলিয়েভনা গেলেন তার স্বামীর কাছে এবং জোর দিয়ে ফরাসিতে বললেন, বেশ! এখন আমাকে বলল কী হয়েছিল?
কিছু না, আমার বন্ধু।
বন্ধু না! একজন দূত এসেছিল, তাই না?
যা-ই হোক, আমি তোমাকে তা বলতে পারব না।
তুমি বলতে পারবে না? বেশ, আমিই তাহলে তোমাকে বলছি!
তুমি?
হাজি মুরাদ ছিলেন, তাই না? ইংরেজিতে বললেন মারিয়া ভাসিলিয়েভনা। তিনি কয়েক দিন ধরে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার কথা শুনেছিলেন এবং ভেবেছিলেন, হাজি মুরাদ স্বয়ং তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। ভরন্তসভ তা একদম অস্বীকার করতে পারলেন না। কিন্তু তাকে (ম) এ কথা বলে হতাশ করলেন যে হাজি মুরাদ নিজে ছিলেন
কিন্তু একজন দূত পাঠিয়েছিলেন বলতে যে তিনি আগামীকাল তার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। যেখানে তারা গাছ কাটার অভিযানে যাবেন, সেখানে।
তরুণ ভরসভরা, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই, দুর্গের একঘেয়ে জীবনে এই ঘটনায় খুশি হয়েছিলেন এবং এই খবরে তার বাবা কী রকম খুশি হবে, সে নিয়ে কথা বলার পর তারা ঘুমাতে গেলেন। রাত তখন দুটোর বেশি।
৪
তাকে ধরার জন্য শামিলের পাঠানো মুরিদদের এড়াতে তিনটি রাত নির্ঘম কেটেছে। তাই সাদো শুভরাত্রি জানিয়ে ঘর থেকে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজি মুরাদ ঘুমিয়ে পড়েন। পুরো পোশাক পরা অবস্থায় হাতের ওপর মাথা রেখে। তার কনুই মেজবানের সাজিয়ে দেওয়া লাল তাকিয়াটির একদম ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল।
একটু দূরে দেয়ালের পাশে ঘুমিয়েছিল এলডার। সে শুয়েছিল চিত হয়ে। তার সবল হাত-পা এমনভাবে ছড়ানো, যাতে চাপকানের সামনে সেলাই করে আটকানো কাজের কালো থলেগুলো মাথাটির চেয়ে উঁচু হয়ে ছিল। তার সদ্য কামানো মাথাটা বালিশ থেকে পেছনের দিকে গড়িয়ে পড়েছিল। তাতে নীল আয়নার মতো নিচের কিছুটা অংশও দেখা যাচ্ছিল। তার ওপরের ঠোঁট বাচ্চাদের ঠোঁটের মতো একবার ফুলে উঠছিল আবার নিচে নামছিল, যেন সে কিছুতে চুমুক দিচ্ছে। হাজি মুরাদের মতো সে-ও পিস্তল এবং ছোরা বেল্টের সঙ্গে গেঁথে রেখেই ঘুমিয়েছিল। আগুনের মালসাটার ঝাঁঝরির ওপর কাঠিগুলো অল্প আঁচে নিবু নিবু। রাতের বাতিটা মিটমিট করছিল দেয়ালের ছোট্ট কোটরে।