শোন, ওই লক্ষ্মীছাড়া জানোয়ারগুলো শোনো কী রকম চিল্লাচ্ছে!
ওরা তোমার হেঁড়ে গলা শুনে হাসছে, চিকন গলায় বলল ইউক্রেন থেকে আসা সৈন্যটা।
আবার সব নিস্তব্ধ। শুধু বাতাস গাছের ডালগুলো দোলাচ্ছে কখনো তারাগুলো ঢেকে দিয়ে, কখনো খুলে!
শোনো, পানভ, হঠাৎ প্রফুল্ল মেজাজে জিজ্ঞেস করল আভদিয়েভ, তোমার কি কখনো মন খারাপ লাগে?
মন খারাপ, কেন? কোনো গা না করেই জবাব দিল পান।
বেশ, আমার মন খারাপ লাগে, কোনো কোনো সময় এত খারাপ লাগে যে জানি না আমি আমার কী করে ফেলতে পারি।
ও, এই কথা! এটুকুই পানভের জবাব।
সেইবার আমি যখন সব টাকা মদ খেয়ে উড়িয়ে দিলাম, ওটা মন খারাপের জন্যই হয়েছিল। তা আমাকে ধরে ফেলেছিল, এমনভাবে ধরে ফেলেছিল যে আমি মনে মনে বললাম, আমি বেহেড মাতাল হয়ে যাব।
কিন্তু কখনো কখনো মদ খেলে তা আরও খারাপ হয়।
হ্যাঁ, আমারও তা-ই হয়েছিল। কিন্তু একজন নিজেকে নিয়ে কী করতে পারে?
কিসের জন্য তোমার এত মন খারাপ হয়?
আমার, কী…কেন, আমার বাড়ির জন্য মন টানে।
তাহলে তোমাদের কি অবস্থাপন্ন বাড়ি?
না, আমরা ধনী নই, কিন্তু স্বচ্ছন্দে চলে যায়। আমরা ভালো আছি। এরপর আভদিয়েভ পানভের কাছে বহুবার বলা কাহিনি আবার বলতে শুরু করল।
দেখো, আমি আমার নিজের ইচ্ছায় ভাইয়ের বদলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছি, আভদিয়েভ বলল। তার (ভাইয়ের) বাচ্চাকাচ্চা আছে। পরিবারে তারা পাঁচজন। আর আমি কেবল বিয়ে করেছি। মা এসে আমাকে যাওয়ার জন্য মিনতি করতে থাকল। তাই আমি ভাবলাম, বেশ, তারা হয়তো মনে রাখবে আমি কী করেছি। তাই আমি আমার মালিকের কাছে গেলাম…সে ভালো মনিব ছিল, বলল, তুমি একটা ভালো লোক, যাও! তাই আমি আমার ভাইয়ের বদলে গেলাম।
বেশ, সেটা ভালো কাজ করেছ, পানভ বলল।
তারপর দেখো পানভ, আমাকে বিশ্বাস করো, আমার যে মন খারাপ হয়, তার বড় কারণ সেই ঘটনা? কেন তুমি তোমার ভাইয়ের বদলে গেলে? আমি নিজেকে প্রশ্ন করি। সে এখন সেখানে রাজার হালে থাকছে, আর আমি এখানে কষ্ট করে মরছি। আমি যত চিন্তা করি, আমার তত খারাপ লাগে…মনে হয় আমার কপালই খারাপ!
আভদিয়েভ চুপ করে গেল।
একটু থেমে সে বলল, আমরা বোধ হয় আরেকবার ধূমপান করতে পারি।
ঠিক আছে, বানাও! কিন্তু সৈন্যদের ধূমপান করার সুযোগ হলো না। আভদিয়েভ পাইপের নলটি ঠিকমতো বসানোর জন্য উঠতেই তারা গাছের মর্মর শব্দ ছাপিয়ে রাস্তায় পায়ের আওয়াজ পেল। পানভ তার বন্দুক তাক করে ধরল এবং নিকিতিনকে তার পা দিয়ে ধাক্কা দিল।
নিকিতিন উঠে তার পশমি আলখাল্লাটা তুলে নিল।
বন্দারেঙ্কো নামের তৃতীয় সৈন্যটাও উঠল এবং বলল, বন্ধুরা, আমি এমন একটা স্বপ্ন দেখলাম…।
শসস! ইশারা করল আভদিয়েভ, সৈন্যরা সবাই দম বন্ধ করে শুনল। একাধিক মানুষের পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে, নাল লাগানো বুট পরা পায়ের নয়। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ঝরা পাতা আর ডালের টুকরার ওপর মচমচ শব্দ পরিষ্কার থেকে বেশি পরিষ্কার হয়ে আসছে। তারপর এল গলার খাদ থেকে আসা বিশেষ শব্দ। কথা বলার সময় চেচেনরা এমন শব্দ করে। সৈন্যরা এখন কেবল শব্দই শুনতে পাচ্ছে না, দেখতে পেল গাছগুলোর মধ্যে ফাঁকা জায়গা দিয়ে দুটো ছায়া হেঁটে যাচ্ছে, একটা ছায়া অন্যটার চেয়ে লম্বা। ছায়াগুলো সৈন্যদের বরাবর এলে পানভ হাতে বন্দুক নিয়ে রাস্তার ওপর উঠে এল, তার সহকর্মীরা তার অনুসরণ করল।
কে যায়? হাক দিল সে।
আমি, বন্ধু চেচেন, খাটো লোকটি বলল। লোকটা বাটা! বন্দুক নাই, তলোয়ার নাই! নিজের দিকে দেখিয়ে বলল সে। প্রিন্সকে চাই!
লম্বা লোকটি বন্ধুর পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তার কাছেও কোনো অস্ত্র ছিল না।
সে বলছে যে তাকে খবর নিতে পাঠানো হয়েছে, কর্নেলের সঙ্গে দেখা করতে চায়, পানভ তার সঙ্গীদের বুঝিয়ে বলল।
প্রিন্স ভরন্তসভ…বেশি চাই! বড় কাজ! বলল বাটা।
ঠিক আছে, ঠিক আছে! আমরা তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব, পানভ বলল। তুমি বরং এদের নিয়ে যাও, আভদিয়েভকে বলল, তুমি আর বন্দারেঙ্কো, এদের ডিউটি অফিসারের কাছে দিয়ে ফিরে এসো। মনে থাকবে? সে আরও বলল, সাবধান, এদের তোমাদের সামনে রাখবে!
এটা করলে কেমন হয়? আভদিয়েভ তার বন্দুক আর বেয়নেট দিয়ে কাউকে খোঁচানোর ভঙ্গি করে বলল। আমি যদি এক খোঁচায় তার ভুড়ি বের করে দিই?
তুমি তাকে মেরে ফেললে তার কী দাম থাকবে? মন্তব্য বন্দারেঙ্কোর।
এখন হাঁটো!
খবর নিতে আসা লোকদের নিয়ে যাওয়া সৈন্য দুটির পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে পানভ আর নিকতিন নিজেদের চৌকির জায়গায় ফিরে এল।
কিসের জন্য তারা রাত্রে এখানে এসেছে? প্রশ্ন নিকতিনের।
মনে হয় খুব দরকার, বলল পানভ। ঠান্ডা কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে, বলে সে তার পশমি আলখাল্লাটার ভাঁজ খুলে গায়ে দিয়ে গাছটার পাশে বসল।
ঘণ্টা দুয়েক পর আভদিয়েভ আর বন্দারেঙ্কো ফিরে এল।
কী, তাদের বুঝিয়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ, কর্নেলের বাড়িতে তারা এখনো ঘুমায়নি। তাদের সোজা তার কাছে নিয়ে গেছে এবং জানো বন্ধুরা, ন্যাড়া ছেলেগুলি বেশ ভালো? আভদিয়েভ বলে যাচ্ছিল। হ্যাঁ, সত্যি? আমি তাদের সঙ্গে কত গল্প করলাম!
অবশ্যই, তুমি তো বলবেই, পাত্তা না দিয়ে বলল নিকতিন।
আসলেই, তারা ঠিক রুশদের মতো। ওদের একজন বিবাহিত! বাচ্চা আছে দুটো! এত কথা বললাম! ভালো লোক দুটো!