এ ধরনের কথায় খুশি হয়ে সাদো নীরবে তার হাত বুকের ওপর রাখল।
কুঁড়ের দরজা বন্ধ করে আগুনে কিছু খড়ি দিয়ে সাদো অত্যন্ত খুশিমনে ঘর থেকে কুঁড়ের যেদিকটায় তার পরিবারের সবাই থাকে, সেদিকে চলে গেল। মেয়েরা তখনো ঘুমায়নি এবং তাদের মেহমানখানায় রাত কাটানো বিপজ্জনক অতিথিদের সম্বন্ধে কথা বলছিল।
২
হাজি মুরাদ যে গ্রামে রাত কাটাচ্ছিলেন, সেখান থেকে পনেরো ভাস্ত (দৈর্ঘ্যের রুশ মাপ, এক মাইল প্রায় দেড় ভাস্তের সমান) দূরে সীমান্তের দুর্গ ভজভিঝেনস্ক। দুর্গ থেকে শাহগিরনস্কি ফটক দিয়ে তিনজন সৈন্য ও একজন এনসিও (ননকমিশন্ড অফিসার) কুচকাওয়াজ করে বের হয়ে এল। ককেশাসে রুশ সৈন্যদের তখনকার পোশাক ছিল উরু পর্যন্ত লম্বা ভেড়ার চামড়ার কোট, ফারের টুপি এবং হাঁটু অবধি লম্বা বুট। চারজনের দলটির সবার পরনে তেমন পোশাক আর পিঠে ঝোলানো ভাঁজ করা পশমি আলখাল্লা। অস্ত্র কাঁধে নিয়ে সৈন্যরা প্রথমে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলল। তারপর প্রায় ৫০০ কদম গিয়ে ঘুরল। ডান দিকে গেল প্রায় ২০ কদম তাদের বুট দিয়ে শুকনা পাতায় মচমচ শব্দ করে। তারা থামল সেখানে পড়ে থাকা একটা চিনার গাছের গুঁড়ির কাছে। গুঁড়িটা এত কালো যে অন্ধকারেও ওটাকে দেখা যাচ্ছিল। এই চিনারের গুঁড়িটা তাদের ওত পেতে থাকার জায়গা।
সৈন্যরা বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে আসার সময় গাছগুলোর ওপর দিয়ে উজ্জ্বল তারাগুলোও তাদের সঙ্গে আসছিল বলে মনে হচ্ছিল। সেগুলো এখন স্থির, পাতাহীন ডালগুলোর মধ্য দিয়ে জ্বলজ্বল করছিল।
ভাগ্য ভালো যে এটা শুকনা, সার্জেন্ট পানভ বলল, তারপর কাধ থেকে খটাং করে রাইফেল আর বেয়নেটটা নামিয়ে চিনারের গুঁড়িটায় ঠেস দিয়ে রাখল। সৈন্য তিনটিও একই কাজ করল।
নিশ্চয়ই আমি ওটা হারিয়েছি! খেঁকিয়ে বিড়বিড় করল পানভ। নিশ্চয়ই রেখে এসেছি, নাহয় পথে কোথাও পড়ে গেছে।
কী খুঁজছ? উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল একজন সৈন্য।
আমার পাইপের বোলটা। শয়তানটা যে কোথায় গেল?
নলটা কি তোমার কাছে আছে? জিজ্ঞেস করল সৈন্যটা।
এই তো নলটা।
তাহলে এটা সোজা মাটিতে পুঁতে ফেলছ না কেন?
ওটার দরকার নেই!
দাঁড়াও, এক মিনিটের মধ্যে ব্যবস্থা করে ফেলব।
ওত পাতার সময় ধূমপান নিষেধ, কিন্তু এটা নামেই ওত পাতা। বরং এটাকে বলা যায় পাহারাচৌকি। আগে পাহাড়িরা লুকিয়ে কামান নিয়ে এসে দুর্গের দিকে গোলা ছুড়ত। সেটা যাতে করতে না পারে, সে জন্য এই পাহারার ব্যবস্থা। পানভ ধূমপানের আনন্দ বাদ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, তাই উৎসাহী সৈন্যটার প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। সৈন্যটা তার পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে মাটিতে একটা গর্ত খুঁড়ল। ওটার চারদিক সমান করে পাইপের নলটা তার মধ্যে লাগিয়ে দিল, তারপর সে গর্তটা তামাক দিয়ে ভরে চেপে দিল; তৈরি হয়ে গেল পাইপ। গন্ধকের দেশলাই মুহূর্তের জন্য জ্বলে মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে পড়া সৈন্যটির চওড়া চোয়ালে আলো ফেলল। নলের ভেতর দিয়ে বাতাস হিস হিস করছিল, পোড়া তামাকের মিষ্টি গন্ধ গেল পানভের নাকে।
ঠিক করেছ? উঠে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করল।
কেন নয়, অবশ্যই!
তুমি একাট চটপটে ছেলে, আভদিয়েভ!…একজন বিচারকের মতো বিজ্ঞ! তাহলে বেটা।
আভদিয়েভ মুখ থেকে ধোঁয়া বের হতে দিয়ে পানভের জন্য জায়গা করে দিতে গড়িয়ে পাশ ফিরল।
উন্মুখ পানভ শুয়ে পড়ে নলের মুখের দিকটা হাতা দিয়ে মুছে তামাক টানতে শুরু করল।
ধূমপান করার সময় সৈন্যরা কথা বলতে শুরু করল।
সবাই বলছে কমান্ডার আবার ক্যাশ-বাক্স হাতিয়েছে, অলস কণ্ঠে একজনের মন্তব্য। জুয়া খেলায় সে হেরেছে, জানো?
সে আবার ফেরত দিয়ে দেবে, পানভ বলল।
অবশ্যই সে দেবে! সে একজন ভালো অফিসার, সায় দিল আভদিয়েভ।
বেশ! বেশ! যে এই আলাপ শুরু করেছিল, হতাশভাবে সে বলল। আমার মতে কোম্পানির (সেনাদল) উচিত তার সঙ্গে কথা বলা। তুমি যদি টাকা নিয়ে থাকো, তাহলে বলল কত নিয়েছ এবং কখন তা ফেরত দেবে।
কোম্পানি যদি ঠিক করে, তাহলে সেটাই হবে, পাইপ থেকে সরে গিয়ে বলল পানভ।
অবশ্যই। দশে মিলি করি কাজ, প্রবাদটি বলে সায় দিল আভদিয়েভ।
বসন্তের আগে যব আর বুট কিনতে হবে। তখন টাকা লাগবে, সে যদি টাকা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে, তাহলে কী হবে? নাখোশ সৈন্যটি বলল।
আমি তোমাকে বলছি কোম্পানির যা ইচ্ছা তা-ই হবে, আবার বলল পানভ। এটাই প্রথম না সে টাকা নেয়, আবার ফেরত দিয়ে দেয়।
তখনকার দিনে ককেশাসে প্রতিটা কোম্পানি তার রসদ বিভাগ চালানোর জন্য নিজেরাই লোক ঠিক করত। তারা রাজস্ব বিভাগ থেকে প্রতি মাসে ১০০ টাকা (৬ রুবল ৫০ কোপেক) পেত এবং কোম্পানির খাবারের ব্যবস্থা করত। তারা বাঁধাকপি চাষ করত, খড়ের গাদা বানাত, তাদের নিজেদের এক্কা থাকত এবং তাদের হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়াগুলো নিয়ে তারা গর্ব করত। কোম্পানির টাকা রাখা হতো একটা সিন্দুকে, যেটার চাবি থাকত কমান্ডারের কাছে; প্রায়ই সে সিন্দুক থেকে টাকা ধার নিত। তেমন ঘটনাই আবার ঘটেছে, সৈন্যরা যা নিয়ে আলাপ করছিল। নাখোশ সৈন্যটি, নিকতিন, চায় কমান্ডারের কাছ থেকে হিসাব চাওয়া হোক, আর পানভ ও আভদিয়েভ মনে করে তার দরকার নেই।
পানভের পর নিকতিন ধূমপান করল, তারপর তার আলখাল্লাটা বিছিয়ে তার ওপর বসল চিনারের গুঁড়িটিতে হেলান দিয়ে। সবাই তখন নিশ্চুপ। কেবল তাদের মাথার অনেক ওপরে গাছের মগডালের পাতাগুলো বাতাসে মর্মর শব্দ করছিল। সেই অবিরাম মৃদু মর্মর শব্দ ছাপিয়ে হঠাৎ শুরু হলো শিয়ালের হুক্কাহুয়া, গোঙানি, আর্তনাদ ও খুক খুক হাসি।