চলুন, আমরা তলোয়ার দিয়ে ওদের চামড়া তুলে ফেলি! তৃতীয়বারের মতো বলল এলডার। মাটির বাঁধটার পেছন থেকে শত্রুর দিকে ছুটে যেতে সে প্রস্তুত। সেই মুহূর্তে একটা গুলি এসে লাগল তার গায়ে। সে ধনুকের মতো বেঁকে পেছনে হাজি মুরাদের পায়ের ওপর পড়ে গেল। হাজি মুরাদ দেখলেন, তার ভেড়ার মতো চোখ উৎসুক দৃষ্টিতে ভোলা। তার মুখে ওপরের ঠোঁটটা শিশুর ঠোঁটের মতো ভোলা। মুখ থেকে বুদবুদ বের হচ্ছে। হাজি মুরাদ তার নিচ থেকে নিজের পা বের করে নিয়ে আবার গুলি চালাতে শুরু করলেন।
খানেফি এলডারের শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়ে তার চাপকানের ভেতর থেকে ব্যবহার না করা গুলিগুলো বের করে নিতে শুরু করল।
খান মাহোমা তার জিকির চালিয়ে যাচ্ছিল, ফাঁকে ফাঁকে গুলিও করছিল। শত্রুরা চিৎকার করতে করতে সাবধানে এক ঝোঁপের আড়াল থেকে অন্য ঝোঁপের আড়ালে দৌড়ে যাচ্ছিল এবং একটু একটু করে কাছে চলে আসছিল।
হাজি মুরাদের বাঁ দিকে আরেকটি গুলি লাগল। তিনি আবার শুয়ে পড়ে বেশমেত থেকে তুলো বের করে গুঁজে দিলেন। কিন্তু আঘাতটা ছিল মারাত্মক। তার মনে হলো তিনি মারা যাচ্ছেন। তার কল্পনায় একের পর এক ছবি ও স্মৃতি ভেসে উঠতে শুরু করল। দেখলেন আবু নুতসাল খান এক হাতে ছোরা আর অন্য হাতে কাটা গাল চেপে ধরে শত্রুর দিকে তেড়ে যাচ্ছে, তারপর দেখলেন দুর্বল রক্তশূন্য ভরসভের মুখ। কানে বাজল তার ধূর্ত মুখে নরম গলার কথা। তারপর তিনি দেখলেন তার ছেলে ইউসুফ ও স্ত্রী সোফিয়ার মুখ। তারপর তার চোখে ভেসে উঠল ফ্যাকাশে ও লাল দাড়িওয়ালা শত্রু শামিলের মুখ, আধবোজা চোখ। এই সব ছবি ভেসে ওঠার সময় তার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না–না দয়া, না রাগ বা অন্য কোনো রকম ইচ্ছা জাগল না। তার মধ্যে যা শুরু হতে যাচ্ছিল বা শুরু হয়ে গিয়েছিল, তার তুলনায় অন্য সবকিছু তুচ্ছ।
তা সত্ত্বেও সবল দেহে তিনি যে কাজ শুরু করেছিলেন, তা-ই চালিয়ে গেলেন। সব শক্তি সঞ্চয় করে তিনি বাধের পেছন থেকে উঠে তার দিকে দৌড়ে আসা একটা লোককে লক্ষ্য করে গুলি করলেন। লোকটা পড়ে গেল। তারপর হাজি মুরাদ পরিখা থেকে বের হয়ে এলেন। ভীষণ খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছোরা হাতে এগিয়ে গেলেন সোজা শত্রুর দিকে।
কয়েকটি গুলি ফুটল। তিনি বাঁকা হয়ে পড়ে গেলেন। কয়েকজন সৈন্য বিজয় উল্লাসে তার পড়ে যাওয়া দেহটার দিকে দৌড়ে গেল। কিন্তু মৃত মনে হওয়া শরীরটা হঠাৎ নড়ে উঠল। প্রথমে খালি ন্যাড়া মাথাটা উঠল, পরে একটা গাছের গুঁড়ি হাত দিয়ে ধরে উঠল শরীরটা। তাকে এত ভয়ংকর দেখাচ্ছিল যে যারা তার দিকে দৌড়ে আসছিল, তারা থমকে দাঁড়াল। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তার শরীরটা গাছ থেকে ছিটকে উপুড় হয়ে পড়ল। কাঁটা গেন্ধালির মতো শরীরটা পড়ল পুরো লম্বা হয়ে। তিনি আর নড়লেন না।
তিনি নড়তে পারছিলেন না, কিন্তু অনুভব করতে পারছিলেন। তার কাছে সবচেয়ে আগে এসেছিল হাজি আগা। সে একটা বড় ছোরা দিয়ে তার মাথায় আঘাত করল। হাজি মুরাদের মনে হলো, কেউ হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন না, কে বা কেন তা করছে। এটাই ছিল শরীর নিয়ে তার শেষ চেতনা। তার আর কোনো হুঁশ ছিল না। শত্রুরা তার শরীরে লাথি মারতে আর কোপাতে শুরু করল, যেটার মধ্যে তাদের মতো প্রাণ ছিল না।
হাজি আগা লাশটার পিঠে পা দিয়ে দাঁড়াল এবং দুই কোপে তার মাথাটা কেটে ফেলল এবং পা দিয়ে ওটা সরিয়ে দিল সাবধানে, যাতে জুতায় রক্ত লেগে না যায়। ঘাড়ের ধমনিগুলো থেকে ফিনকি দিয়ে তাজা লাল রক্ত বের হয়ে এল, আর মাথা থেকে কালো রক্তে ঘাসগুলো ভিজতে থাকল।
কারগান, হাজি আগা, আহমেদ খান ও সৈন্যরা হাজি মুরাদের লাশ এবং তার সঙ্গীদের চারপাশে (খানেফি, খান মাহোমা আর গামজালোকে বেঁধে ফেলা হয়েছিল) শিকারির মতো ঘিরে দাঁড়াল। ঝোঁপগুলোর ওপরে বারুদের ধোয়ার মধ্যে তারা বিজয় উল্লাস করছিল।
গোলাগুলির সময় বুলবুলিগুলো গান থামিয়ে দিয়েছিল। আবার সেগুলো তীক্ষ্ণ সুরে গাইতে শুরু করল। প্রথমটা একদম কাছ থেকে, তারপরে দূরেরগুলো।
.
চষা খেতের মধ্যে দলে যাওয়া কাটা গেন্ধালির ডালটা দেখে যে মৃত্যুর ঘটনা আমার মনে পড়েছিল, এটাই সে ঘটনা।