জেগে জেগে রাতের সব রকম শব্দ শুনছিলেন হাজি মুরাদ। পাখির গানের কাঁপা সুরে তার মনে এল হামজাদকে নিয়ে গানটি। আগের রাতে পানি আনতে গিয়ে তিনি যেটা শুনেছিলেন। মনে হলো তার নিজের অবস্থাও সে রকম। তিনি সেটাই চাইলেন। চট করে তার মন বদলে গেল। চাদর বিছিয়ে নামাজ পড়লেন তিনি। নামাজ শেষ না করতেই শুনতে পেলেন একটা শব্দ তাদের দিকে আসছে। সেটা ছিল বানে ডোবা খেতের মধ্য দিয়ে আসা অনেকের পায়ের শব্দ।
হুঁশিয়ার বাটা ঝোঁপটার কিনারে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে কিছু ছায়া দেখতে পেল। হেঁটে আর ঘোড়ায় চড়ে কিছু লোক আসছে। খানেফিও অন্যদিকে সে রকম লোকদের দেখতে পেল। ওই জেলার সেনা কমান্ডার কারগানভ তার আধা সামরিক বাহিনী নিয়ে আসছে।
হাজি মুরাদ ভাবলেন, তাহলে আমরা হামজাদের মতোই লড়ব।
বিপৎসংকেত পেয়ে কারগানভ তার আধা সামরিক আর কসাক সৈন্যদের দল নিয়ে হাজি মুরাদকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু সারা দিনে তার কোনো চিহ্নও পায়নি। আশা ছেড়ে দিয়ে সে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল। সন্ধ্যার দিকে সে একটা বুড়ো লোককে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ঘোড়ায় চড়া কোনো লোককে যেতে দেখেছে কি না। বুড়ো বলল দেখেছে। ছয়জন লোককে পথ ভুল করে ধানখেতের মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছে। সে যেই জঙ্গলটা থেকে লাকড়ি কুড়াচ্ছিল, সেখানেই তাদের ঢুকতে দেখেছে। কারগানভ ঘুরে বুড়ো লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে চলল। বাধা ঘোড়াগুলো দেখে সে নিশ্চিত হলো, হাজি মুরাদ সেখানেই। রাতে সে ঝোঁপটাকে ঘিরে রাখল, যাতে সকালে হাজি মুরাদকে জীবিত বা মৃত ধরতে পারে।
ঘেরাও হয়ে গেছেন বুঝতে পেরে আর ছোট ছোট গাছের মধ্যে একটা খন্দক দেখতে পেয়ে হাজি মুরাদ সেটায় নেমে গেলেন। ঠিক করলেন, শক্তি আর গুলি থাকা পর্যন্ত লড়বেন। সঙ্গীদের তিনি তা বলে গর্তটার সামনে একটা বাঁধ দিতে বললেন। তারা সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেল। ডালপালা কেটে ফেলল আর ছোরা দিয়ে মাটি তুলে একটা পরিখা খুঁড়ল। হাজি মুরাদ নিজেও তাদের সঙ্গে হাত লাগালেন।
আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদের কমান্ডার ঝোঁপটার কাছে এসে চিৎকার করে বলল,
হাজি মুরাদ, হার মানো। আমরা অনেক, তোমরা মাত্র কয়েকজন!
জবাবে এল রাইফেলের একটা গুলি। আর গর্তটা থেকে ধোয়ার একটা রেখা উঠল। গুলিটা কমান্ডারের ঘোড়ায় লাগে। ঘোড়াটা তার নিচে টাল খেয়ে পড়ে যায়। সৈন্যদের তরফে শুরু হলো পাল্টা গুলির বৃষ্টি। শাঁই শাঁই করে তাদের গুলিগুলো পাতা আর ছোট ছোট ডাল ভেঙে ফেলল। কিছু গিয়ে লাগল গর্তটার বাধে। কিন্তু সেটার আড়ালে কারও গায়ে লাগেনি। অন্যগুলোর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ায় গামজালোর ঘোড়াটার মাথায় একটা গুলি লাগে। ওটা পড়ে না গিয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌড়ে অন্যগুলোর কাছে যায়। ওটার রক্তে ঘাস ভিজে যায়। হাজি মুরাদ আর তার সঙ্গীরা কোনো সৈন্য কাছে এলেই কেবল গুলি করে আর তাদের নিশানা ব্যর্থ হয় খুব কম। তিনজন সৈন্য আহত হয়। আর অন্যরা পরিখার কাছে না গিয়ে ক্রমেই পিছু হটতে থাকে আর দূর থেকে দিগবিদিক গুলি করতে থাকে।
এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে এমন চলল। সূর্য গাছগুলোর মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠেছে। হাজি মুরাদ তার ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠে নদীর দিকে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। তখনই আরও অনেক লোক আসায় তাদের গোলমালের শব্দ শোনা গেল। মেখতুলির হাজি আগা তার লোকদের নিয়ে এসেছিল। প্রায় দুই শ জন। হাজি আগা একসময় হাজি মুরাদের মিত্র ছিল এবং পাহাড়ে তার সঙ্গেই থাকত। কিন্তু পরে সে রুশদের পক্ষে চলে যায়। তার সঙ্গে ছিল হাজি মুরাদের পুরোনো শত্রুর ছেলে আহমেদ খান।
কারগানভের মতো হাজি আগাও হাজি মুরাদকে হার মেনে নিতে বলে। হাজি মুরাদও আগের মতোই গুলি ছুঁড়ে জবাব দেয়।
তলোয়ার হাতে নাও! চিৎকার করে আদেশ দিয়ে হাজি আগা নিজেরটাও বের করে। প্রায় এক শ লোক তীব্র চিৎকার করে তলোয়ার নিয়ে ঝোঁপের মধ্যে হামলা করে।
হাজি আগার যোদ্ধারা ঝোঁপের মধ্যে দৌড়াতে থাকে আর পরিখা থেকে একটার পর একটা গুলিও আসতে থাকে। তিনজন পড়ে যাওয়ার পর হামলাকারীরা ঝোপে ঢোকা বন্ধ করে বাইরে থেকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। গুলি করতে করতে তারা ধীরে ধীরে পরিখার দিকে এগোতে শুরু করে এক ঝোঁপের আড়াল থেকে আরেক ঝোপে দৌড়ে গিয়ে। কেউ কেউ তা করতে পারল। অনেকে হাজি মুরাদ ও তার সঙ্গীদের গুলিতে মারা পড়ল। হাজি মুরাদের কোনো গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি, গামজালোর গুলিও খুব কমই নষ্ট হয়। যতবার তার গুলিতে কেউ পড়ে যায়, ততবারই সে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। খান মাহোমা পরিখার কিনারে বসে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ! পড়ছিল আর মাঝেমধ্যে গুলি করছিল। কিন্তু সেগুলো প্রায়ই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এলডার ছোরা হাতে শত্রুর দিকে ছুটে যাওয়ার জন্য ছটফট করছিল। সে ঘন ঘন এদিক-সেদিক গুলি করছিল পরিখার বাইরে বের হয়ে আর বারবার হাজি মুরাদের দিকে তাকাচ্ছিল। নোংরা খানেফি এখানেও ভূতের কাজই করছিল। হাজি মুরাদ আর খান মাহোমা তার হাতে বন্দুক দিলে সে সাবধানে শিক দিয়ে বারুদ গেদে তাতে তেলে ভেজানো ন্যাকড়ায় মোড়া গুলি ভরে দিচ্ছিল। বাটা অন্যদের মতো পরিখায় থাকেনি। নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসতে দৌড়ে ঘোড়াগুলোর কাছে যায়। আর চিৎকার করে দৌড়াতে দৌড়াতে বন্দুক কোনো কিছুর সঙ্গে না ঠেকিয়েই সে গুলি করছিল। সে-ই আহত হলো সবার আগে। তার ঘাড়ে গুলি ঢুকেছিল। সে বসে পড়ল। রক্তমাখা থুতু ছিটিয়ে সে শাপশাপান্ত করতে থাকল। তারপর আহত হলো হাজি মুরাদ। একটা গুলি তার কাঁধে ঢুকেছিল। বেশমেতের ভেতরের দিক থেকে কিছু তুলো ছিঁড়ে ক্ষতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে তিনি আবার গুলি চালাতে থাকলেন।