তাই মনে করো!
হাজি মুরাদ আরও জোরে চলছিলেন।
বন্ধু, ওইভাবে যাবেন না। দাঁড়ান! চিৎকার করে বলে নাজারভ হাজি মুরাদকে কাটিয়ে যেতে শুরু করল।
হাজি মুরাদ পিছে তাকালেন। কিছু না বলে একই রকম জোরে যেতে থাকলেন।
দেখো, শয়তানগুলো কিছু একটা করবে! বলল ইগ্নাতভ। তারা দূরে সরে যাচ্ছে।
তারা পাহাড়ের দিকে প্রায় এক মাইল চলে এসেছে।
আমি বলে দিচ্ছি এতে কোনো কাজ হবে না! চিৎকার করে বলল নাজারভ।
হাজি মুরাদ উত্তর দিলেন না, ফিরেও তাকালেন না। শুধু ঘোড়াটা আরও জোরে ছোটালেন।
ধোঁকাবাজ! তোমাকে যেতে দেব না! চিৎকার করে নাজারভ বুটের আল দিয়ে ঘোড়াটাকে খোঁচা দিল। দুরঙা খোঁজা ঘোড়াটায় চাবুক মেরে পাদানিতে ভর দিয়ে উবু হয়ে দাঁড়িয়ে হাজি মুরাদকে ধরতে ছুটল।
উজ্জ্বল আকাশ আর পরিষ্কার বাতাসে নাজারভের বুক ভরে গেল এক খেলার আনন্দে। কারণ, তার সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়াগুলোর একটায় মসৃণ পথে সে হাজি মুরাদকে ধাওয়া করছিল। ওই আনন্দের কারণে তার মনে কোনো দুঃখজনক বা ভয়ানক ঘটনার চিন্তা আসেনি। প্রতি কদমেই সে হাজি মুরাদের কাছে চলে আসছিল বলে সে খোশমেজাজে ছিল।
তার পেছনে বড় ঘোড়াটার খুরের আওয়াজ থেকে হাজি মুরাদ হিসাব করলেন কতক্ষণে সেটা তাকে কাটিয়ে যাবে। তিনি ডান হাত দিয়ে পিস্তলটা ধরলেন আর বাঁ হাতে রাশ টেনে তার কাবার্ডা ঘোড়াটার গতি কমিয়ে আনলেন। পেছনে আরেকটা ঘোড়ার আওয়াজ পেয়ে ওটা উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল।
আমি বলছি, আপনি এ রকম করবেন না! হাজি মুরাদের ঘোড়াটার লাগাম ধরার জন্য বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিতে দিতে নাজারভ চিৎকার করে বলল। কিন্তু সেটা ধরার আগেই একটা গুলি ছোঁড়া হলো। আপনি কী করছেন, বুকে হাত চেপে নাজারভের চিৎকার। ছেলেরা, এদের আটকাও। চিৎকার করে সে উপুড় হয়ে জিনে চড়ার হাতলটার ওপর পড়ে গেল।
কিন্তু পাহাড়িরা আগেই তাদের হাতিয়ার তুলে নিয়ে কসাকদের ওপর পিস্তলের গুলি চালায় আর তলোয়ার দিয়ে কোপায়।
নাজারভ তার ঘোড়াটার ঘাড়ে ঝুলে থাকল। ঘোড়াটা তার সঙ্গীদের চারপাশে ঘুরছিল। ইগ্নতভ আর দুজন পাহাড়ির পা দলে তার ঘোড়াটা পড়ে গেল। কিন্তু পাহাড়িরা না নেমেই তলোয়ার বের করে ইগ্নাতভের মাথা আর হাতে কোপ মারে। পেত্রাকভ সহযোদ্ধাদের উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসার চেষ্টা করতেই দুটো গুলি লাগল তার পিঠে ও পাশে। সে একটা বস্তার মতো ঘোড়া থেকে পড়ে গেল।
মিশকিন ঘোড়া ঘুরিয়ে জোর কদমে ছুটল দুর্গের দিকে! খানেফি আর বাটা তাকে ধাওয়া করে কিন্তু সে ততক্ষণে এত দূর চলে গিয়েছিল যে তাকে। ধরতে পারল না। তাই তারা অন্যদের কাছে ফিরে এল।
পেত্রাকভ পড়ে ছিল চিত হয়ে। তার পেট কেটে ভুড়ি বের হয়ে এসেছে। তার কচি মুখটা আকাশের দিকে, মারা যাওয়ার আগে সে মাছের মতো শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিল।
ইগ্নাতভকে তলোয়ার দিয়ে শেষ করে গামজালো নাজারভের ওপরও একটা কোপ দিল। মৃতদের শরীর থেকে গুলির থলিগুলো খুলে নিল বাটা। খানেফি নাজারভের ঘোড়াটা নিতে চাইল কিন্তু হাজি মুরাদ তাকে বারণ করলেন এবং রাস্তা ধরে এগোতে থাকলেন। মুরিদরা তাকে অনুসরণ করল। নাজারভের ঘোড়াটা তাদের সঙ্গে আসছিল কিন্তু তারা ওটাকে খেদিয়ে দেয়। তারা ইতিমধ্যে নুখা থেকে ছয় মাইল চলে এসেছে। ধানখেতের মধ্য দিয়ে চলছে। তখন দুর্গের কামান থেকে সতর্কতার সংকেত হিসেবে একটা গোলা দাগা হলো।
.
হায় হায়! হায় খোদা! এটা তারা কী করল? হাজি মুরাদের পালানোর খবর শুনে দুই হাতের মধ্যে মাথা রেখে দুর্গের কমান্ডার চিৎকার করতে থাকল। তারা আমার সর্বনাশ করেছে। তারা তাকে পালাতে দিয়েছে, পাজি শয়তানগুলো? মিশকিনের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনে তার হা-হুতাশ।
সব জায়গায় বিপৎসংকেত দেওয়া হলো। শুধু সেখানকার কসাই না, রুশপন্থী গ্রামগুলো থেকে যত যোদ্ধা পাওয়া গেল, সবাইকে পলাতকদের খুঁজতে লাগানো হলো। হাজি মুরাদকে জীবিত বা মৃত ধরে আনার জন্য এক হাজার রুবল পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। কসাকদের কাছ থেকে হাজি মুরাদ আর তার সঙ্গীরা পালানোর দুই ঘণ্টার মধ্যে দুই শ অশ্বারোহী ভারপ্রাপ্ত অফিসারের অধীনে পলাতকদের ধরার জন্য বের হলো।
রাস্তা দিয়ে কয়েক মাইল যাওয়ার পর হাজি মুরাদ তার হয়রান ঘোড়াটার অবস্থা দেখলেন। সাদা ঘোড়াটা ঘেমে ছাইরং হয়ে গিয়েছে।
রাস্তার ডান দিকে বেলারঝিক গ্রামের বাড়িগুলো আর মিনার দেখা যাচ্ছে। বাঁ দিকে কিছু খেত, তারপরই নদী। পাহাড়গুলো ডান দিকে হলেও হাজি মুরাদ উল্টো বাঁ দিকে চলতে শুরু করলেন। ভাবলেন, তাকে ধরতে সৈন্যরা অবশ্যই ডান দিকে যাবে। আর তিনি বড় রাস্তা ছেড়ে আলাজান পার হয়ে অপর দিকের বড় রাস্তায় পড়বেন। যেখানে তার যাওয়ার কথা কেউ ভাববে না। ওই রাস্তা ধরে বনের পাশ দিয়ে গিয়ে নদীটা আবার পার হয়ে পাহাড়ের পথ ধরবেন।
এই ভেবে তিনি বা দিকে ঘুরলেন। কিন্তু নদীর কাছে যাওয়া অসম্ভব। ধানখেতগুলো বসন্তকালের বন্যায় ডুবে গেছে। ঘোড়ার খুর কাদায় দেবে যাচ্ছে। হাজি মুরাদ ও তার সঙ্গীরা কখনো ডানে, কখনো বায়ে ঘুরছেন একটু শুকনা মাটির আশায়। কিন্তু খেতগুলো সবখানেই ডুবেছে। কাদার গর্ত থেকে ঘোড়াগুলো খুর টেনে ওঠানোর সময় বোতলের ছিপি খোলার মতো পপ পপ শব্দ হচ্ছে। ওগুলো কয়েক কদম পরপর হাঁপিয়ে থেমে যাচ্ছে। এইভাবে সন্ধ্যা নেমে আসা পর্যন্ত তারা নদীর কাছে পৌঁছাতে পারলেন না। তাদের বা দিকে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে একটু উঁচু জায়গা দেখে হাজি মুরাদ ঠিক করলেন সেখানে রাত পর্যন্ত থাকবেন। ঘোড়াগুলো যাতে জিরিয়ে নিতে পারে। তারা সঙ্গে আনা রুটি আর পনির খেয়ে নিলেন। শেষ পর্যন্ত রাত নেমে এল। চাঁদটা প্রথমে উজ্জ্বল আলো দিলেও পাহাড়ের আড়ালে ডুবে গেল। আবার অন্ধকার। এলাকাটায় অসংখ্য বুলবুলি। তাদের ঝোঁপটাতেও দুটো ছিল। মানুষগুলো কথা বলার সময় ওগুলো কোনো শব্দ করেনি। কিন্তু তারা চুপ করলে বুলবুলিগুলো ডাকতে শুরু করল।