ঠিক আছে…দাড়ি লম্বা আর কথা খাটো হওয়া উচিত, বললেন হাজি মুরাদ।
বাটা বলল, ঠিক আছে, আমি তাহলে চুপ করলাম।
খাড়া পাহাড়ের কাছে আরগুন নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে বনের ফাঁকা জায়গাটায় দুটো চাই আছে, তুমি চেনো? হাজি মুরাদ জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ, চিনি।
সেখানে চারজন ঘোড়সওয়ার আমার জন্য অপেক্ষা করছে, বললেন হাজি মুরাদ।
হ্যাঁ, মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল বাটা।
সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে খান মাহোমা কে? সে জানে কী করতে হবে আর কী বলতে হবে। তুমি তাকে রুশ সেনাপতি প্রিন্স ভরসভের কাছে নিয়ে যেতে পারবে না?
আমি তাকে নিয়ে যাব। তাকে নিয়ে যাবে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। পারবে?
পারব।
তাকে নিয়ে যাও আর বনের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। আমিও সেখানে অপেক্ষা করতে থাকব।
আমি তা-ই করব, উঠতে উঠতে বলল বাটা আর বুকের ওপর তার হাত দুটো রেখে বের হয়ে গেল।
বাটা চলে যাওয়ার পর হাজি মুরাদ ফিরলেন গৃহকর্তার দিকে।
একটা লোককে চেখিতেও পাঠাতে হবে, তিনি বলতে শুরু করলেন এবং তার চাপকানের গুলির থলেগুলোর একটা হাতে নিতেই দুজন মহিলাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই তা রেখে দিলেন।
তাদের একজন সাদোর স্ত্রী–পাতলা গড়নের মধ্যবয়সী যে মহিলা আগে হাজি মুরাদের জন্য তাকিয়া সাজিয়ে দিয়েছিল। অন্য মেয়েটি অল্প বয়সী, লাল পায়জামা আর একটা সবুজ বেশমেত পরেছে। রুপোর টাকার একটা মালা তার পোশাকের সামনের দিকের পুরোটাই ঢেকে রেখেছে। তার ঘন কালো চুলের বেণিটা লম্বা না হলেও বেশ মোটা তার কাঁধের পাতলা হাড়ের ফলক দুটোর মাঝখানে বেণির শেষ প্রান্তে একটা রুপোর রুবল ঝুলছে। বাবা ও ভাইয়ের চোখের মতো তার চোখ দুটোও বঁইচি ফলের মতো কালো। তার কচি মুখে জ্বলজ্বল করছে আর মুখটা চেষ্টা করছে বড়দের মতো শক্ত হতে। সে অতিথিদের দিকে তাকায়নি কিন্তু তাদের উপস্থিতি ঠিকই বুঝতে পারছিল।
সাদোর স্ত্রী একটা নিচু গোলটেবিল নিয়ে এল, যেটার ওপরে চা, মাখনে ভাজা পিঠা, পনির, রুমালি রুটি আর মধু। মেয়েটি নিয়ে এসেছে একটা গামলা, একটা বদনা আর একটা তোয়ালে।
পয়সার গয়নাগুলোয় টুংটাং শব্দ তুলে মেয়েরা যতক্ষণ অতিথিদের জন্য আনা জিনিসগুলো সাজিয়ে সামনে দিতে পাতলা চটি পরা নরম পায়ে চলাফেরা করছিল, সাদো আর হাজি মুরাদ ততক্ষণ নীরব ছিলেন। ভেড়ার চোখের মতো চোখ দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে ভাঁজ করা পা দুটোর দিকে তাকিয়ে মূর্তির মতো বসে ছিল এলডার, মেয়েরা ঘরের মধ্যে থাকার পুরো সময়টায়। তারা চলে যাওয়ার পর তাদের হালকা পায়ের আওয়াজ দরজার পেছন থেকে যখন আর শোনা যাচ্ছিল না, কেবল তখন সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
হাজি মুরাদ চাপকানের একটা গুলির থলেতে আটকে যাওয়া একটা গুলি বের করে ওটার নিচ থেকে একটা পাকানো নোটও বের করে আনলেন। নোটটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, আমার ছেলেকে এটা দিতে হবে।
পৌঁছে সংবাদ কাকে দিতে বলব?
তোমাকে, আর তুমি জানিয়ে দেবে আমাকে।
এটা করা হবে, বলে সাদো নোটটা তার নিজের কোটের একটা গুলির পকেটে রাখল। তারপর পিতলের বদনাটা হাতে নিয়ে গামলাটা হাজি মুরাদের দিকে এগিয়ে দিল।
হাজি মুরাদ তার সাদা পেশিবহুল হাতের ওপর থেকে বেশমেতের আস্তিন একটু গুটিয়ে সাদোর বদনা থেকে ঢালা পরিষ্কার ঠান্ডা পানির নিচে হাতটা বাড়িয়ে ধরলেন। আনকোরা ভোয়ালেতে হাত মুছে হাজি মুরাদ ঘুরে বসলেন টেবিলটার দিকে। এলডারও একই কাজ করল। অতিথিদের খাওয়ার সময় মুখোমুখি বসে তাদের আগমনের জন্য বেশ কয়েকবার ধন্যবাদ জানাল সাদো। দরজার পাশেই তার জ্বলজ্বলে চোখ দিয়ে হাজি মুরাদের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে বসে থাকা সাদোর ছেলেটি একটু মুচকি হাসল যেন বাবার কথাতেই সায় দিতে।
গত চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময়ে হাজি মুরাদ কিছুই না খেলেও এখন সামান্য একটু রুটি আর পনির খেলেন। তারপর তার ছোরার খাপ থেকে ছোট্ট একটা ছুরি বের করে তা দিয়ে রুটির টুকরোয় একটু মধু মাখালেন।
আমাদের মধু ভালো, হাজি মুরাদকে মধু খেতে দেখে খুশি হয়ে বুড়ো বলল। এবার অন্য সব বছরের চেয়ে অনেক বেশি আর ভালো হয়েছে।
আপনাকে ধন্যবাদ, বলে হাজি মুরাদ টেবিল থেকে সরে বসলেন। এলডার আরও খেতে চেয়েছিল, কিন্তু সে তার নেতার অনুসরণ করল এবং টেবিল থেকে সরে বদনা আর গামলাটা এগিয়ে দিল হাজি মুরাদের দিকে।
সাদো জানত সে তার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে হাজি মুরাদকে বাড়িতে বসিয়ে। কারণ, তার সঙ্গে দ্বন্দ্বের পর শামিল চেচনিয়ার সব বাসিন্দার ওপর হুকুম দিয়েছে হাজি মুরাদকে আশ্রয় দিলে তাদের মরতে হবে। সে জানত, গ্রামবাসী যেকোনো মুহূর্তে তার বাড়িতে হাজি মুরাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যেতে পারে এবং তাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি করতে পারে। এটাতে সে কেবল ভয়ই পায়নি, কিছুটা মজাও পেয়েছিল। সে ভাবছিল, জীবন দিয়ে হলেও অতিথিকে রক্ষা করা তার কর্তব্য এবং তার কর্তব্য করতে পারার জন্য সে গর্ববোধ করছিল আর নিজের ওপর খুশি ছিল।
আমার ঘাড়ের ওপর মাথাটা যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, সে আবার বলল হাজি মুরাদকে।
হাজি মুরাদ সাদোর চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন সে সত্যি বলছে, তারপর দোয়া করার মতো বললেন, তুমি দীর্ঘজীবী আর সুখী হও!