সে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু ধরা পড়ে যায়, বলে কামিনে মাথাটা কসাক সৈন্যটার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বাটলারের সঙ্গে বাড়ির ভেতরে ঢুকল।
সে বীরের মতো মরেছে, কামিনেভ বলল।
কিন্তু এত সব ঘটল কীভাবে?
একটু দাঁড়াও। মেজর আসুক। সবই বলব। আমাকে এই জন্যই পাঠানো হয়েছে। সব কটি দুর্গ আর গ্রামে এটা দেখাতে হবে।
মেজরকে খবর পাঠানো হলো। সে তার মতোই মাতাল আরও দুজন অফিসারের সঙ্গে এসে কামিনেভকে জড়িয়ে ধরল।
আমি হাজি মুরাদের মাথাটা নিয়ে এসেছি, বলল কামিনেভ।
না?…খুন হয়েছে?
হ্যাঁ, পালাতে চেয়েছিল।
আমি সব সময় বলেছি সে ধোঁকা দিতে এসেছে!…কোথায় সেটা? মানে মাথাটা আমি দেখতে চাই।
কসাক সৈন্যটাকে ডাকা হলো। সে মাথাসহ ব্যাগটা আনল। মাথাটা বের করার পর মেজর মাতাল চোখে ওটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
সব আগের মতো আছে, সে ভালো মানুষ ছিল, বলল মেজর। আমি তাকে চুমু দিতে চাই।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। এটা এক বীরের মাথা, বলল অফিসারদের একজন।
সবাই মাথাটা দেখার পর সৈন্যটার কাছে সেটা ফিরিয়ে দেওয়া হলো। মেঝেয় যত কম সম্ভব লাগিয়ে যত্ন করে সে মাথাটা ব্যাগে ঢোকাল।
কামিনেভ, আমার প্রশ্ন, মাথাটা দেখানোর সময় তুমি কী বলো, একজন অফিসার প্রশ্ন করল।
না!…আমাকে তাকে চুমু দিতে দাও। সে আমাকে একটা তলোয়ার দিয়েছে চিৎকার করে বলল মেজর।
বাটলার বের হয়ে এল গাড়িবারান্দায়।
সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে মেরি দমিত্রিয়েভনা বসে ছিল। সে ঘুরে একবার বাটলারের দিকে তাকাল, তারপর রেগে ঘুরে বসল।
কী হয়েছে, মেরি দমিত্রিয়েভনা? বাটলার জিজ্ঞেস করল।
তোমরা সবাই খুনি!…আমি এসব ঘেন্না করি! সত্যিই তোমরা খুনি, বলে উঠে গেল সে।
যে কারও জীবনে এটা ঘটতে পারে, কী বলবে না বুঝে বাটলার মন্তব্য করল। এটাই যুদ্ধ।
যুদ্ধ! আসলেই, যুদ্ধ!…খুনির দল আর কিছু না। একটা লাশ মাটির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। আর তারা সেটা নিয়ে আমোদ করছে!…আসলেই গলাকাটা খুনি, বলতে বলতে সিঁড়ি থেকে নেমে সে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
বাটলার ফিরে গেল ঘরে, কামিনেভকে কীভাবে এটা ঘটল তা বিস্তারিত বলতে বলল।
এবং কামিনেভ সব বলল।
ঘটনাটা পরের অধ্যায়ে।
২৫
শহরেই আশপাশে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি ছিল হাজি মুরাদের। তবে সঙ্গে সব সময়ই একদল কসাক সৈন্য রাখতে হবে। নুখায় কসাক সৈন্যের সংখ্যা সাকল্যে পঁচিশ। তাদের প্রায় অর্ধেকই ছিল আবার অফিসারদের কাজে। বাকিদের মধ্য থেকে দশজনকে হাজি মুরাদের সঙ্গে দেওয়ার আদেশ পালন করতে হলে একই দলকে এক দিন পরপর একই কাজ করতে হতো। তাই প্রথম দিন দশজন দেওয়া হলেও ভবিষ্যতে তা পচে নামানোর সিদ্ধান্ত হয়। আর হাজি মুরাদকে তার লোকদের সবাইকে সঙ্গে না নিতে বলা হয়। কিন্তু ২৫ এপ্রিল তিনি তাদের সবাইকে নিয়ে বের হন। তিনি ঘোড়ায় চড়লে তার পাঁচ সহকারীও সঙ্গে চলল। তাই দেখে কমান্ডার বলে যে তিনি তাদের সবাইকে নিতে পারেন না। কিন্তু হাজি মুরাদ না শোনার ভান করে ঘোড়া চালিয়ে দেন। কমান্ডার আর জোর করেনি।
কসাক দলের সঙ্গে একজন নিম্নপদস্থ অফিসার (এনসিও) ছিল। সাহসিকতার জন্য নাজারভ সেন্ট জর্জেস ক্রস পদক পেয়েছিল। সে ছিল গোলাপের মতো টাটকা এক বাদামি চুলের তরুণ। এক দরিদ্র গোড়া খ্রিষ্টান পরিবারের বড় ছেলে। পিতৃহীন অবস্থায় সে বড় হয়। বুড়ি মা, তিনটি বোন আর দুই ভাই নিয়ে তার পরিবার।
নাজারভ, তার কাছাকাছি থেকো! কমান্ডার চিৎকার করে আদেশ দিল।
ঠিক আছে, স্যার! বলে নাজারভ ঘোড়ায় উঠে পিঠের রাইফেলটা ঠিক করে নিল। তার দুরঙা বড় খোঁজা ঘোড়াটা জোর কদমে চালিয়ে দিল। তার পিছে পিছে চলল চারজন কসাক : লম্বা ছিপছিপে থেরাপভ, পেশায় চোর আর লুটেরা। (সে-ই গামজালোর কাছে বারুদ বিক্রি করেছিল।) সুঠামদেহী চাষি ইগ্নাতভ! যে নিজের গায়ের জোর নিয়ে বড়াই করত! সেনাবাহিনীতে তার বাধ্যতামূলক চাকরি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। সে আর তরুণ ছিল না। মিশকিন ছিল কমজোর। সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। আর ছিল মায়ের একমাত্র ছেলে সুন্দর চুলের পেত্রাকভ। সব সময় অমায়িক আর আমুদে।
সকালটা কুয়াশাঢাকা হলেও পরে পরিষ্কার হয়ে যায়। পাতার কলি, কুমারীর মতো নতুন গজিয়ে ওঠা দূর্বা, কচি ভুট্টার মোচা এবং রাস্তার বাঁ দিকে তরতর করে বয়ে চলা নদীর ছোট ছোট ঢেউ কেবল দেখা যাচ্ছিল। সবই কাঁচা রোদে চকচক করছিল।
হাজি মুরাদ ধীরে ধীরে চলছিলেন। তার পিছু পিছু কসাকরা আর তার সহকারীরা। রাস্তাটি ধরে হেঁটে হেঁটে তারা দুৰ্গটা ছাড়িয়ে গেলেন। রাস্তায় দেখতে পেলেন মেয়েরা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছে, সৈন্যরা ঘোড়ার গাড়ি চালাচ্ছে আর মহিষগুলো ক্যাচক্যাচে গাড়ি টেনে চলেছে। মাইল দেড়েক যাওয়ার পর হাজি মুরাদ তার সাদা কাবার্ডা জাতের ঘোড়াটা একটু জোরে চালালেন। তার সঙ্গে থাকতে কসাক ও সহকারীদের ঘোড়া দুলকি চালে চালাতে হলো।
বাহ, কী সুন্দর তার ঘোড়াটা। সে যদি এখনো শত্রু থাকত, তাহলে আমি তাকে গুলি করে ফেলে দিতাম! বলল থেরাপন্তভ।
ঠিকই বলেছ। তিবলিসে ঘোড়াটার জন্য তিন শ রুবল দিতে চেয়েছিল।
আমার ঘোড়াটা নিয়ে আমি তার আগে চলে যেতে পারি, নাজারভ বলল।