এপ্রিলের শেষে দুর্গে একটি সেনাদল এল। বারিয়াতিনস্কি তাদের দিয়ে চেচনিয়ার সরাসরি আক্রমণ করতে চায়। এত দিন সেটা অসম্ভব মনে করা হতো। সেনাদলে কাবার্ড রেজিমেন্টের দুটো কোম্পানি ছিল। ককেশীয় রীতিতে কুরিণ কোম্পানিগুলো তাদের মেহমান হিসেবে যত্ন করত। সৈন্যদের থাকতে দেওয়া হলো ব্যারাকে। রাতের খাবারে বাজরার পরিজের সঙ্গে দেওয়া হলো তোদকা। অফিসাররা কুরিন অফিসারদের বাড়িতে জায়গা পেল। স্বভাবতই সেই সঙ্গে রাতের খাবারও। ডিনারে রেজিমেন্টের গায়ক দল গাইল। তা শেষ হলো মদ্যপান দিয়ে। মেজর পেত্ৰভ আর রক্তিমাভ ছিল না, ফ্যাকাশে ছাইয়ের মতো হয়ে গিয়েছিল। দুই পা দুই দিকে ছড়িয়ে একটা চেয়ারে বসা। তলোয়ার বের করে কাল্পনিক শত্রুকে এফোঁড়-ওফোড় করছিল। মুখে কখনো খিস্তি আর কখনো হাসি। কখনো কাউকে জড়িয়ে ধরছে আবার কখনো নাচছে প্রিয় গানের সুরে।
শামিল হাঙ্গামা করেছে
পেছনের দিনগুলোয়;
টারা রা রা টা টা
পেছনের বছরগুলোয়!
বাটলারও সেখানে ছিল। এই গানেও সে যুদ্ধের কবিতা খুঁজতে চেষ্টা করল। কিন্তু মনের গভীরে মেজরের জন্য তার খারাপ লাগছিল। কিন্তু তাকে থামানো ছিল অসম্ভব। মাথাটা ধোয়াটে হয়ে উঠছে অনুভব করে বাটলার নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে বাসায় চলে গেল।
চাঁদের আলোয় সাদা বাড়িগুলো আর রাস্তার পাথরগুলো উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। প্রতিটা নুড়ি, খড় আর ছোট ছোট ধুলার চিপি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। বাসার কাছাকাছি গেলে বাটলারের দেখা হলো মেরি দমিত্রিয়েভনার সঙ্গে। তার মাথা ও ঘাড়ে একটা শাল জড়ানো। মেরির কাছে ঘেঁকা খাওয়ার পর বাটলার লজ্জায় তাকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু চাঁদের আলো আর পেটে মদের কারণে তাকে দেখে বাটলার খুশি। আবার ভাব জমাতে ইচ্ছা হলো তার।
কোথায় যাচ্ছ? সে জিজ্ঞেস করল।
কেন, আমার বুড়োর খোঁজে, মিষ্টি করে জবাব দিল মেরি। বাটলারকে সে সত্যি সত্যি প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু তাকে বাটলারের এড়িয়ে চলা সে পছন্দ করেনি।
তার জন্য ভাবছ কেন? সে শিগগিরই চলে আসবে।
আসলেই কি আসবে?
সে না এলে তারা নিয়ে আসবে।
এই অবস্থা…এটা তো ভালো না!…তুমি বলছ আমার না যাওয়াই ভালো?
না, যেয়ো না। তার চেয়ে বাড়ি চলো।
মেরি দমিত্রিয়েভনা ফিরে তার পাশাপাশি হেঁটে চলল। চাঁদের দারুণ উজ্জ্বল আলোয় মনে হচ্ছিল তাদের মাথার ছায়ার চারপাশে দুটো আলোর বলয় চলছে। বর্তিকা দুটোর দিকে তাকিয়ে বাটলার ভাবছিল, আবার বলবে সে মেরিকে কত পছন্দ করে। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে, বুঝতে পারছিল না। মেরি তার কথা শোনার জন্য চুপ করে ছিল। তাই তারা কোনো কথা না বলে বাড়ির কাছে চলে এসেছে। সে সময় কয়েকজন ঘোড়সওয়ার দেখতে পেল। একজন অফিসার কয়েকজন দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
তোমারা কারা? পাশে সরে মেরি দমিত্রিয়েভনা জিজ্ঞেস করল। চাঁদটা ঘোড়সওয়ারদের পেছন দিকে থাকায় তারা বাটলার ও তার কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত তাদের চিনতে পারেনি।
তুমি কি পিটার নিকোলায়েভিচ? আগন্তুককে মেরির প্রশ্ন।
হ্যাঁ, আমি, কামিনে বলল। আহ, বাটলার, কেমন আছ?…এখনো ঘুমাওনি? মেরি দমিত্রিয়েভনার সঙ্গে বেড়াতে বের হয়েছ! সাবধান, মেজর কিন্তু তোমাকে দেখিয়ে দেবে।…কোথায় সে?
কোথায় আবার, ওই ওখানে…শোনো! মেরি দমিত্রিয়েভনা জবাব দিল নাগড়া বাজার শব্দের দিকে আঙুল দেখিয়ে। তারা আমোদ-ফুর্তি করছে।
কী জন্য? তোমাদের লোকেরা কি নিজেরা নিজেরাই ফুর্তি করে?
না। হাসাভ-ইয়ার্ট থেকে কয়েকজন অফিসার এসেছে। তাদের আদর যত্ন করা হচ্ছে।
ভালোই হলো! আমি ঠিক সময়ে এসেছি…মেজরের সঙ্গে আমার একটু দেখা করা দরকার।
কোনো কাজে? বাটলার জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ, ছোট্ট একটা কাজ।
ভালো না খারাপ?
সেটা নির্ভর করে।…আমাদের জন্য ভালো, কিছু লোকের জন্য খারাপ, বলে হাসল কামিনেভ।
তারা ইতিমধ্যে মেজরের বাসার পৌঁছেছে।
শিখিরেভ, চিৎকার করে একজন কসাককে ডাকল কামিনেভ, এখানে এসো।
সঙ্গের কসাকরা ছিল ডন অববাহিকার। তাদের মধ্য থেকে একজন এগিয়ে এল। পরনে সাধারণ ডন কসাকদের উর্দি, লম্বা বুট, গলায় বাধা লম্বা পশমি জোব্বা, কাঁধে ব্যাগ।
কামিনেভ নেমে ঘোড়াটা নিয়ে যেতে বলল।
কসাক সৈন্যটিও ঘোড়া থেকে নেমে ব্যাগ থেকে একটা থলে বের করল। কামিনে থলেটা তার কাছে থেকে নিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল।
বেশ, আমি তোমাদের একটা নতুন জিনিস দেখাব! ভয় পেয়ো না মেরি দমিত্রিয়েভনা?
আমি কেন ভয় পাব?
এই দেখো! বলে কামিনেভ থলে থেকে একটা মানুষের মাথা বের করল। চাঁদের আলোয় ওটা তুলে ধরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা চিনতে পেরেছ?
ওটা ছিল একটা ন্যাড়া মাথা, মোটা ভুরু, ছোট করে ছাঁটা কালো দাড়ি ও গোঁফ, এক চোখ খোলা, অন্যটা আধবোজা। ন্যাড়া মাথাটায় চিড় ধরা কিন্তু সোজা নয়, নাকে জমাট রক্ত। ঘাড়টা রক্তমাখা ভোয়ালে দিয়ে প্যাঁচানো। নীল ঠোঁট শিশুর মতো দয়ালু অভিব্যক্তি ধরে আছে।
মেরি দমিত্রিয়েভনা মাথাটার দিকে তাকিয়েই দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
বাটলার বীভৎস মাথাটা থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। ওটা ছিল সেই হাজি মুরাদের মাথা, যার সঙ্গে কয়েক দিন আগেই বন্ধুর মতো মিশেছে।
এটা কেমন করে হলো? কে তাকে খুন করেছে? সে জিজ্ঞেস করল।