যাও পাখি উড়ে, আমাদের ঘরে ঘরে!
বলে গিয়ে মায়েদের বোনেদের,
বল গিয়ে প্রিয়তমা বধূদের,
আমরা শহীদ জিহাদে! আমাদের লাশ
কখনো রবে না শুয়ে কবরের ঘুমে!
শরীর খুবলে খাবে নেকড়ের দল,
চোখগুলো যাবে কাক-শকুনের পেটে।
শোকের সুরে গানটা শেষ হলে বাটা ভরাট গলায় চিৎকার করে উঠল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ! তারপর সব চুপ। কেবল বাগানে বুলবুলির চুক চুক চুক চুক গান। দরজার পেছনে পাথরে লোহা ঘষার শব্দ।
হাজি মুরাদ এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে খেয়াল করেননি কখন হাতের জগ থেকে পানি পড়ে গেছে। হুঁশ হলে মাথাটা নেড়ে আবার নিজের ঘরে ঢুকলেন। ফজর নামাজ পড়ার পর নিজের অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে বিছানায় বসলেন। তার আর কিছুই করার ছিল না। বাইরে যেতে হলে তাকে ভারপ্রাপ্ত অফিসারের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু দিনের আলো ফোটেনি, অফিসার তখনো ঘুমিয়ে।
খানেফির গান তাকে আরেকটি গান মনে করিয়ে দিল। গানটা তার জন্মের ঠিক পরপর তার মায়ের রচনা। তার বাবার উদ্দেশে এই গানটার কথাই হাজি মুরাদ লরিস-মেলিকভকে বলেছিলেন।
দামেস্ক ইস্পাতে গড়া তোমার তলোয়ার আমার শুভ্র বুক চিরেছিল;
অবশ্য তার পাশেই রেখেছি ছোট্ট ছেলেটিকে;
আমার উষ্ণ লহুস্রোতে ধুয়েছি তাহারে; এবং সে ক্ষত
ওষধি ও যত্ন বিনা দ্রুতই শুকায়,
মৃত্যুর মুখেও আমি ভয়হীনা, সে-ও তা-ই,
আমার বাচ্চা, অশ্বারোহী, মুক্ত থাকবে সে ভয়ডর থেকে!
হাজি মুরাদের মনে পড়ল কেমন করে তার মা তাকে বাড়ির ছাদে চাদর মুড়ে পাশে শুইয়ে রাখতেন। তিনি কেমন করে মায়ের কাটা দাগটি দেখতে চাইতেন। হাজি মুরাদের মনে হলো তিনি মাকে সামনে দেখছেন–লোল চর্ম, পাকা চুল ফোকলা দাঁতে তিনি শেষবার যেমন দেখেন, তেমন নয়। সুন্দরী সুঠাম তরুণী পাঁচ বছরের ভারী ছেলেটিকে পিঠের ঝুড়িতে যেভাবে পাহাড়ে বাবার কাছে নিয়ে যেতেন, সেই রূপে। তার দাদার কথাও মনে হলো। চামড়ায় ভাজ পড়ে যাওয়া, সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো তার বলিষ্ঠ হাতে রুপার ওপর হাতুড়ি দিয়ে কাজ করতেন। তাকে নামাজ পড়তে বাধ্য করতেন।
তার মনে পড়ল পাহাড়ের পায়ের কাছে ঝরনাটার কথা। তার লম্বা পায়জামা গুটিয়ে তিনি মায়ের সঙ্গে পানি আনতে যেতেন। মনে পড়ল কৃশকায় কুকুরটার কথা, যেটা তার গাল চেটে দিত। বিশেষ করে মনে পড়ল টক দুধ আর ধোয়ার অদ্ভুত গন্ধ। দুধ দোয়ানো বা দুধ জ্বাল দেওয়ার সময় মা তাকে চালাঘরে নিয়ে গেলে ধোয়ায় সেই গন্ধ পেতেন। মা প্রথমবার তার চুল কামিয়ে দেওয়ার ঘটনা তার মনে আছে। ঘরের দেয়ালে ঝোলানো চকচকে পিতলের গামলায় তার ঘন নীল মাথা দেখে কী অবাকই না তিনি হয়েছিলেন।
নিজের ছোটবেলার স্মৃতি তাকে ছেলের কথা মনে করিয়ে দিল। ইউসুফের চুল প্রথমবার তিনিই কামিয়ে দিয়েছিলেন। এখন ইউসুফ একজন সুদর্শন তরুণ অশ্বারোহী যোদ্ধা। শেষবার দেখা ইউসুফের চেহারা মনে হলো তার। হাজি মুরাদ তসেলমেস থেকে চলে আসার দিন শেষ দেখেছিলেন। তার ছেলে ঘোড়া এনে দিয়ে তার সঙ্গে আসার অনুমতি চেয়েছিল। অস্ত্রসজ্জিত ইউসুফ তার নিজের ঘোড়ায় লাগাম হাতে তৈরি ছিল। তার সুশ্রী চেহারায় গোলাপি আভা এবং ছিপছিপে লম্বা গড়ন (সে বাবার চেয়ে লম্বা) যেন শ্বাস নেয় দুঃসাহস, তারুণ্য আর জীবনের আনন্দের। কম বয়সী হলেও চওড়া কাঁধ, চিকন কোমর, বলিষ্ঠ লম্বা হাত, শক্তি, নমনীয়তা ও চলাফেরায় ক্ষিপ্রতা হাজি মুরাদকে মুগ্ধ করত।
তুমি বরং থেকেই যাও। বাড়িতে তুমি মা, দাদিমার খেয়াল রেখো, হাজি মুরাদ বলেছিলেন। তার মনে আছে কী তেজ, অহংকার আর আনন্দ নিয়ে ইউসুফ জবাব দিয়েছিল, জান থাকতে কেউ মা-দাদিমার ক্ষতি করতে পারবে না। ইউসুফ বাবাকে ঝরনা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে যায়। তারপর থেকে হাজি মুরাদ তার স্ত্রী, মা আর ছেলেকে দেখেননি। শামিল এই ছেলেরই চোখ তুলে নিতে চায়। তার স্ত্রীর কী হবে হাজি মুরাদ ভাবতে চাননি।
এসব চিন্তায় তিনি উত্তেজিত হয়ে আর বসতে পারলেন না। লাফিয়ে উঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজার কাছে গেলেন, খুলে এলডারকে ডাকলেন। সূর্য তখনো ওঠেনি কিন্তু বেশ আলো। বুলবুলিগুলো তখনো ডাকছিল।
যাও, অফিসারকে বলো আমি বাইরে যেতে চাই, আর ঘোড়ায় জিন লাগাও, তিনি বললেন।
২৪
এ সময় বাটলারের একমাত্র সান্ত্বনা ছিল যুদ্ধের কবিতা। সে শুধু কাজের সময় কবিতায় ডুবে যেত তা নয়, নিজস্ব সময়েও। চাপকান গায়ে ঘোড়ায় চড়ে সে ঘুরে বেড়াত। বোগদানোভিচের সঙ্গে দুবার গিয়েছিল ওত পাতার জায়গায়। কোনোবারই তারা কাউকে খুঁজে পায়নি বা মারেনি। সাহসী হিসেবে বোগদানোভিচের সুনাম ছিল। তার সঙ্গে বন্ধুত্বে বাটলার যুদ্ধে থাকার মতো মজা পেত। চড়া সুদে এক ইহুদির কাছ থেকে ধার নিয়ে সে তার ঋণ শোধ করে দিয়েছিল। বরং বলা যায়, সে তার সমস্যার সমাধান না করে শুধু থামিয়ে রেখেছিল। সে তার অবস্থা চিন্তা না করার চেষ্টা করত। তাই শুধু যুদ্ধের কবিতা নয়, মদেও তা ভুলে থাকা। প্রতিদিন সে বেশি করে মদ পান করত, আর দিন দিন নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। আগে সে মেরি দমিত্রিয়েভনার প্রতি জোসেফের মতো পবিত্র ছিল। কিন্তু এখন তার সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটা তাকে সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করায় সে অবাক ও লজ্জিত।