তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। তিনি জানতেন, সেটাই তার শেষবারের চিন্তা। তাকে এখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবশেষে মাথা তুলে তিনি চরদের প্রত্যেককে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বললেন, যাও!
আমরা গিয়ে কী বলব?
বলবে, আল্লাহর যা ইচ্ছা হবে…যাও!
চররা উঠে চলে গেল। হাজি মুরাদ গালিচার ওপর বসে হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।
আমি কী করব? শামিলকে বিশ্বাস করে তার কাছে ফিরে যাব? তিনি ভাবছিলেন। সে একটা শিয়াল, আমার সঙ্গে বেইমানি করবে। সে বেইমানি না করলেও ওই লালমুখো মিথুকের কাছে নত হওয়া অসম্ভব। কারণ, আমি রুশদের কাছে আসার পর সে আর আমাকে বিশ্বাস করবে না। বাজ পাখি নিয়ে একটা তাভিলি গল্প তার মনে পড়ল। ধরা পরার পর বাজটি মানুষের সঙ্গে থাকত। কিছুদিন পর সে পাখিদের মধ্যে ফিরে যায়, পায়ে চামড়ার ঘুঙুর বেঁধে! কিন্তু অন্য পাখিগুলো সেটাকে গ্রহণ করল না। তোমার পায়ে যারা ঘুঙুর বেঁধেছে, তাদের কাছে ফিরে যাও! বলল পাখিগুলো। আমাদের পায়ে ঘুঙুরও নেই, চামড়ার আংটাও নেই। বাজটা নিজের বাসা ছেড়ে যেতে চাইল না, থেকে গেল। কিন্তু অন্য বাজগুলো সেটাকে সেখানে থাকতে দিতে চায়নি, তাই সেটাকে ঠুকরে ঠুকরে মারল।
তারাও আমাকে ওইভাবে ঠুকরে মারবে, হাজি মুরাদ ভাবলেন। আমি কি এখানেই থেকে রুশ জারের জন্য ককেশিয়া জয় করে সুনাম, খেতাব আর টাকাপয়সা পাব?
সেটা হতে পারে, ভরসভের সঙ্গে আলাপ আর প্রিন্স যেসব মিষ্টি কথা বলেছেন, তা মনে করে তিনি ভাবলেন। কিন্তু আমাকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা না হলে শামিল আমার পরিবারকে শেষ করে ফেলবে।
রাতটা হাজি মুরাদ না ঘুমিয়ে চিন্তা করে কাটালেন।
২৩
মাঝরাতের দিকে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। তিনি পাহাড়ে ছুটে যাবেন এবং এখনো যে আভাররা তার অনুগত, তাদের নিয়ে ভিদেনোয় আক্রমণ করবেন। উদ্ধার করে আনবেন পরিবারের সবাইকে, না হয় মৃত্যু। তাদের উদ্ধার করার পর রুশদের কাছে ফিরে যাবেন, না খুনজাখে পালিয়ে গিয়ে শামিলের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, সেটা তিনি ঠিক করেননি। তিনি শুধু জানতেন, রুশদের কাছে থেকে পালিয়ে পাহাড়ে যেতে হবে। তিনি তক্ষুনি পরিকল্পনা কাজে লাগাতে শুরু করলেন।
বালিশের নিচ থেকে দলামোচড়া করে রাখা বেশমেত বের করে ভৃত্যদের কামরায় গেলেন। তারা হলঘরের অন্যদিকে থাকত। সেটার বাইরের দরজাটা খোলা থাকত। ঘরটায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশাভেজা তাজা চাঁদের আলোয় তিনি আবৃত হলেন। তার কান ভরে গেল পাশের বাগানের কয়েকটি পাপিয়ার কাঁপা শিষে।
হলঘরটি পার হয়ে হাজি মুরাদ ভৃত্যদের ঘরের দরজা খুললেন। ঘরে কোনো আলো ছিল না। শুক্লপক্ষের চাঁদের আলো পড়ছিল জানালা দিয়ে। ঘরের একদিকে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার রাখা। হাজি মুরাদের চারজন ভৃত্য গালিচা বা চাদরের ওপর শুয়ে খানেফি ঘোড়াগুলো নিয়ে বাইরে ঘুমাত। গামজালো দরজার কাঁচ কাঁচ আওয়াজ শুনে উঠে গিয়েছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে হাজি মুরাদকে দেখতে পেল। তাকে চিনতে পেরে সে আবার শুয়ে পড়ল। তার পাশেই শুয়ে ছিল এলডার। সে তড়াক করে উঠে বেশমেত পরতে শুরু করল। হাজি মুরাদ আদেশ করবেন এই ভেবে। খান মাহোমা আর বাটা ঘুমিয়েই থাকল। হাতের বেশমেতটা টেবিলের ওপর রাখলেন হাজি মুরাদ। ধপ করে একটা শব্দ হলো ওটার ভেতরে সোনাগুলো সেলাই করে রাখায়।
এগুলোও ভেতরে দিয়ে দাও, এলডারের হাতে সেদিন পাওয়া সোনাগুলো দিয়ে হাজি মুরাদ বললেন। সেগুলো নিয়ে এলভার তখনই চাঁদের আলোয় চলে গেল। তার খাপের নিচ থেকে একটা ছোট ছুরি নিয়ে বেশমেতের ভেতরের কাপড় খুলতে বসে গেল। গামজালো উঠে আসন করে বসে থাকল।
গামজালো, তুমি সবাইকে রাইফেল আর পিস্তলগুলো পরীক্ষা করে দেখতে আর গুলি ভরে তৈরি করে রাখতে বলল। কাল আমরা অনেক দূরে যাব, হাজি মুরাদ বললেন।
আমাদের গুলি আর বারুদ আছে; সবকিছু তৈরি থাকবে, জবাব দিল গামজালো, তারপর হেঁড়ে গলায় চাপা স্বরে কিছু বলল, যা বোঝা গেল না। সে বুঝতে পেরেছিল হাজি মুরাদ কেন রাইফেলগুলো গুলি ভরে প্রস্তুত করতে বলেছেন। শুরু থেকেই তার কেবল একটাই ইচ্ছা। যতগুলো সম্ভব রুশকে খুন করে বা ছোরা মেরে পাহাড়ে পালিয়ে যাওয়া { দিনকে দিন তার সেই ইচ্ছা বেড়েছে। এখন সে বুঝতে পেরেছে হাজি মুরাদও তা-ই চাচ্ছেন। তাতেই গামজালো খুশি।
হাজি মুরাদ চলে যাওয়ার পর গামজালো সঙ্গীদের উঠিয়ে দিল। তারা চারজনই রাতভর রাইফেল, পিস্তল, চকমকি পাথর আর অন্যান্য জিনিস পরীক্ষা করল। কিছু নষ্ট হয়ে থাকলে সেগুলো বদলাল। রাইফেলে বারুদ ভরল। তৈলাক্ত কাপড়ের টুকরায় জড়ানো একেকটি গুলির জন্য বারুদের ছোট ছোট পুঁটলি বানাল। তলোয়ার আর ছোরাগুলোয় শাণ দিয়ে তাল্ল মাখিয়ে রাখল।
ভোর হওয়ার আগেই হাজি মুরাদ অজুর পানি নিতে হলঘরে এলেন। বুলবুলিগুলোর গানে সেদিন যেন উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছিল। আর তার ভৃত্যদের কামরা থেকে ছোরা ও তলোয়ার শাণ পাথরে ঘষার ছন্দময় আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
চৌবাচ্চা থেকে সামান্য পানি নিয়ে হাজি মুরাদ তার ঘরের দরজার কাছে আসতেই মুরিদদের ঘর থেকে শাণের শব্দ ছাপিয়ে শোনা গেল খানেফির গলায় পরিচিত গানের সুর। হাজি মুরাদ শোনার জন্য থামলেন। গানের বাণী কী করে হামজাদ নামের অশ্বারোহী তার সাহসী সৈন্যদের নিয়ে রুশদের কাছ থেকে একপাল সাদা ঘোড়া দখল করে নিয়েছিল। তারপর একজন রুশ প্রিন্স তাকে ধাওয়া করে তেরেক নদী পার করে নিয়ে। বনের মতো বিশাল সেনাদল দিয়ে ঘেরাও করে ফেলে। তার পরের কথাগুলোয় রয়েছে কী করে হামজাদ ঘোড়াগুলো মেরে ফেলে। সেগুলো দিয়ে রক্তাক্ত প্রাচীর বানায়। তার আড়াল থেকে রাইফেলে গুলি, বেল্টে ছোরা আর শিরায় রক্ত থাকা পর্যন্ত তারা লড়ে যায়। মারা যাওয়ার মুহূর্তে হামজাদ আকাশে একটি পাখির ঝাঁক দেখে চিৎকার করে বলে :