তারপর হাজি মুরাদ ট্রান্সককেশীয়ার ছোট্ট নুখা শহরে কিছুদিন থাকার অনুমতি চান। তিনি ভাবছেন, শামিলের কাছ থেকে তার পরিবারকে মুক্ত করার আলোচনা চালাতে সেখান থেকে সুবিধা হবে। তার ওপর নুখা একটা মুসলমান শহর। সেখানে মসজিদ আছে। তার নামাজ এবং ধর্মীয় কাজেও সুবিধা হবে। ভরন্তসভ বিষয়টি পিটার্সবার্গে জানান। কিন্তু তার আগেই হাজি মুরাদকে নুখা যাওয়ার অনুমতি দেন।
ভরন্তসভ, পিটার্সবার্গের কর্তৃপক্ষ এবং হাজি মুরাদের ইতিহাস যারা জানেন, তাদের কাছে পুরো ঘটনাটা ককেশীয় যুদ্ধের সৌভাগ্যসূচক পরিবর্তন। না হলেও মজার একটা ঘটনা। আর হাজি মুরাদের কাছে এটা (বিশেষ করে শেষ দিকে) তার জীবনের এক ভয়ানক সংকট। তিনি পাহাড় থেকে পালিয়েছেন কিছুটা নিজেকে বাঁচানোর জন্য। কিছুটা শামিলের প্রতি ঘৃণায়। পালানোটা কষ্টকর হলেও তার উদ্দেশ্য সফল হয়। বর্তমানে তিনি তার সাফল্যে খুশি। শামিলকে আক্রমণের একটা পরিকল্পনাও তিনি করে ফেলেছেন। কিন্তু তার পরিবারকে উদ্ধারের বিষয়টাকে যতটা সহজ ভেবেছিলেন, দেখা যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি কঠিন।
শামিল তার পরিবারকে বন্দী করে রেখেছে। মহিলাদের ভিন্ন গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। তার ছেলেকে অন্ধ করে ফেলার বা হত্যা করার কথা বলেছে। তিনি মুখা গেছেন দাগেস্তানে তার অনুসারীদের নিয়ে জোর বা বুদ্ধি খাঁটিয়ে তাদের উদ্ধারের চেষ্টায়। নুখায় তার সঙ্গে দেখা করে শেষ চরটি জানিয়ে গেছে দাগেস্তানে তার অনুসারী আভাররা তার পরিবারকে উদ্ধার করে রুশদের পক্ষে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা যথেষ্ট নয়। তাই তারা ভিদেনোয় চেষ্টা করার ঝুঁকি নিচ্ছে না। তার পরিবার এখন ভিদেনোয় আটক। সেখান থেকে তাদের অন্য কোথাও নেওয়া হলে তারা চেষ্টা চালাবে। সে ক্ষেত্রে তাদের সরিয়ে নেওয়ার পথেই তারা আক্রমণ করার ওয়াদা করেছে।
হাজি মুরাদ তার বন্ধুদের জানিয়ে দিলেন যে তার পরিবারের মুক্তির জন্য তিনি তিন হাজার রুবল দেবেন।
নুখায় মসজিদ ও খানের প্রাসাদের কাছে পাঁচ কামরার একটা ছোট বাড়ি হাজি মুরাদকে দেওয়া হলো। তার দায়িত্ব পাওয়া অফিসার, দোভাষী ও ভৃত্যদেরও একই বাড়িতে থাকার জায়গা হলো। হাজি মুরাদের দিন চলল পাহাড়ি এলাকা থেকে বার্তাবাহকদের অপেক্ষায় আর অভ্যর্থনায়। মাঝেমধ্যে অনুমতি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে কাছাকাছি বেরিয়ে।
২৪ এপ্রিল তেমন বেরোনো থেকে ফিরে হাজি মুরাদ খবর পেলেন, তিবলিস থেকে ভরসভের পাঠানো একজন বার্তাবাহক এসেছে। অফিসারটি কী খবর এনেছে, জানার আগ্রহ থাকলেও হাজি মুরাদ যে ঘরে ভারপ্রাপ্ত অফিসার এবং বার্তাবাহক অপেক্ষা করছিল, সেটায় গেলেন না। তার শোবার ঘরে গিয়ে জোহরের নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষ হলে এলেন অভ্যর্থনা ও বসার ঘরে। তিবলিস থেকে আসা কর্মকর্তা কাউন্সিলর কিরিলভ জানাল, ভরন্তসভ চাচ্ছেন হাজি মুরাদ ১২ তারিখে তিবলিস গিয়ে জেনারেল আরগুতিনস্কির সঙ্গে দেখা করুন।
ইয়াকশি! গজগজ করে বললেন হাজি মুরাদ। কাউন্সিলর তাকে খুশি করতে পারেনি। জিজ্ঞেস করলেন, টাকা এনেছ?
জি, এনেছি, কিরিলভের জবাব।
দুই সপ্তাহ দেরি হয়েছে, হাজি মুরাদ প্রথমে দশ আঙুল এবং পরে চার আঙুল দেখিয়ে বোঝালেন। দাও এখানে!
এক্ষুনি দিচ্ছি, বলে কিরিলভ তার ব্যাগের ভেতর থেকে টাকার ছোেট ব্যাগটি বের করল।
টাকা দিয়ে সে কী করবে? রুশ ভাষায় বলল কিরিলভ। ভেবেছিল হাজি মুরাদ বুঝতে পারবেন না। কিন্তু হাজি মুরাদ বুঝেছিলেন এবং রাগতদৃষ্টিতে তাকালেন কিরিলভের দিকে। টাকা বের করতে করতে সে হাজি মুরাদের সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করে। উদ্দেশ্য, ফিরে গিয়ে ভরন্তসভকে হাজি মুরাদ সম্পর্কে খবর দেওয়া। দোভাষীর মাধ্যমে সে জিজ্ঞেস করল হাজি মুরাদের সেখানে ভালো লাগছে কি না। হাজি মুরাদ রেগে বেঁটেখাটো মোটা নিরস্ত্র লোকটির দিকে আড়চোখে তাকালেন। কোনো জবাব দিলেন না। দোভাষী প্রশ্নটা আবার করল।
তাকে বলো আমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারছি না! আমাকে টাকাটা দিতে বলো! বলে হাজি মুরাদ টাকা গোনার জন্য টেবিলে গিয়ে বসলেন। কিরিলভ টাকা বের করে দশটি করে সোনার টাকার সাতটি স্কুপ সাজাল। (হাজি মুরাদ দিনে পাঁচটি সোনার মুদ্রা পেতেন।) তারপর স্তূপগুলো হাজি মুরাদের দিকে ঠেলে দিল। তিনি টাকাগুলো তার চাপকানের পকেটে ঢুকিয়ে আচম্বিতে কিরিলভের টাক মাথায় চাটি মেরে চলে যাওয়ার ইশারা করলেন।
কাউন্সিলর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দোভাষীকে তাকে বলতে বলল তিনি যেন তার (কি) মতো কর্নেল পদমর্যাদার কারও সঙ্গে এমন ব্যবহারের দুঃসাহস না করেন। ভারপ্রাপ্ত অফিসারও তাতে সায় দিলেন। হাজি মুরাদ ঘাড় নেড়ে বোঝালেন তিনি জানেন এবং ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
তাকে নিয়ে কী করা যায়? বলল ভারপ্রাপ্ত অফিসার। তিনি তো ছোরা ঢুকিয়ে দেবেন, ব্যস! কেউ এই শয়তানগুলোর সঙ্গে কথা বলতে পারে না! আমি তো দেখছি সে রেগে গেছে।
সন্ধ্যা হতে শুরু করলে পাহাড় থেকে দুজন চর কাপড়ে চোখ পর্যন্ত ঢেকে তার সঙ্গে দেখা করতে এল। ভারপ্রাপ্ত অফিসার তাদের হাজি মুরাদের কাছে নিয়ে গেল। তাদের একজন মোটাসোটা শ্যামলা তাভিলি, অন্যজন হালকা-পাতলা বুড়ো। তারা হাজি মুরাদের জন্য খুশির খবর আনেনি। যে বন্ধুরা তার পরিবারকে উদ্ধারের ভার নিয়েছিল, তারা শামিলের ভয়ে তা করবে না বলে জানিয়েছে। হাজি মুরাদকে কেউ সাহায্য করলে শামিল তাকে ভয়ংকর নির্যাতন করার হুমকি দিয়েছেন। চরদের কথা শুনে হাজি মুরাদ ভাঁজ করা দুই হাঁটুর ওপর কনুই দুটো রেখে পাগড়ি পরা মাথা নুয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন।