কেন?
তাকে এখন বক্তৃতা দিতে হবে। তিনি মোটেই ভালো বলেন না। এটা গুলির মধ্যে পরিখা দখল করা নয়। তার ওপর পাশে বসা এক মহিলা আর সামনে অফিসাররা!
সত্যি, তার জন্য দুঃখ হয়, অফিসাররা একে অন্যকে বলছিল। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে। বারিয়াতিনস্কি তার গ্লাস তুলে কজলভস্কির উদ্দেশে ছোট্ট বক্তৃতা দিলেন। কজলভস্কি উঠলেন এবং তোতলাতে তোতলাতে শুরু করলেন (তার আবার কেমন করে কথাটি বারবার বলার অদ্ভুত অভ্যাস ছিল), মহামহিমের আদেশ পালন করতে আমি বিদায় নিচ্ছি। ভদ্রমহোদয়গণ, তিনি বললেন। কিন্তু মনে করবেন আমি সব সময় আপনাদের মধ্যেই আছি। সেই প্রবাদটির সত্যতা আপনারা জানেন কেমন করে যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ যোদ্ধা না হয়ে পারেন। অতএব, কেমন করে আমি যেসব পদক পেয়েছি…কেমন করে মহামান্য সম্রাটের বদান্যতায় আমি যেসব সুবিধা পেয়েছি…কেমন করে আমার সব পদ…কেমন করে আমার সুনাম…কেমন করে সবকিছু নির্ধারিতভাবে… কে ম ন ক রে… (এখানে তার গলাটা কেঁপে উঠল) … কেমন করে এর জন্য আমি আপনাদের প্রতি ঋণী, শুধু আপনাদের কাছে বন্ধুরা! তার মুখের ভাঁজ পড়া ত্বক আরও কুঁচকে গেল, তিনি ফুঁপিয়ে উঠলেন, চোখ দিয়ে জল বের হয়ে এল। কেমন করে আমার অন্তর থেকে আপনাদের প্রতি আন্তরিক ও গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই!
জলভস্কি আর বলতে পারলেন না। ঘুরে অফিসারদের আলিঙ্গন করতে শুরু করলেন। প্রিন্সেস রুমালে তার মুখ ঢাকলেন। প্রিন্সের মুখ বিস্ময়ে বাঁকা, তিনি চোখ টিপলেন। অনেক অফিসারের চোখ ভিজে গিয়েছিল। বাটলার কজলভস্কিকে প্রায় না চিনলেও চোখের পানি বন্ধ করতে পারল না। এসব তার খুব ভালো লাগছিল।
তারপর শুরু হলো অন্যান্যের সুস্বাস্থ্য কামনা করে পান, বারিয়াতিনস্কির, ভরন্তসভের, অফিসারদের, সৈন্যদের। তারপর মাতাল অতিথিরা তাদের সামরিক অহংকার নিয়ে টেবিল ছেড়ে চলে যেতে শুরু করলেন। আবহাওয়া ছিল চমৎকার, রৌদ্রোজ্জ্বল, শান্ত। মন চাঙা করা তাজা। বাতাস। চারদিকে চলছিল গান ও বহ্নি উৎসব। মনে হতে পারে সবাই কোনো আনন্দ উদযাপন করছিল। বাটলার পোলতোরাৎস্কির তাঁবুতে গেল আবেগে আপ্লুত হয়ে খুব খুশিমনে। সেখানে আরও কিছু অফিসার এসেছিল, আর একটা তাসের টেবিল পাতা হয়েছিল। একজন অ্যাডজুট্যান্ট এক শ রুবল নিয়ে তহবিল খুলল। ট্রাউজারের পকেটে মানিব্যাগটা চেপে ধরে বাটলার দু-তিনবার তাঁবু থেকে বের হয়ে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ভাই আর নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করা সত্ত্বেও সে আর খেলার প্রলোভন ঠেকাতে পারল না। বাজি ধরতে শুরু করল সে। একটি ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই সে টেবিলে দুই কনুই তুলে বসে তাসের নিচে লেখা বাজির টাকার হিসাবের দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে দেখে। ইতিমধ্যে এত হেরেছে যে সে হিসাব করতেই ভয় পাচ্ছে। কিন্তু সে হিসাব না করেই জানত সে যত ধার নিয়েছে, তাতে তার ঘোড়াটি দিয়ে দিলেও অপরিচিত অ্যাডজুট্যান্টকে টাকা শোধ করতে পারবে না। বাটলার তারপরও খেলা চালিয়ে যেত। কিন্তু অ্যাডজুট্যান্ট হঠাৎ উঠে গিয়ে বাটলারের হারের হিসাব করে ফেলল। বিভ্রান্ত বাটলার তখনই সব টাকা দিতে না পারার জন্য নানা রকম অজুহাত দেখাতে শুরু করল। বলল সে বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দেবে। এ কথা বলার সময় সে দেখল সবাই তার দিকে দয়ার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কিন্তু সবাই, এমনকি পোলতোরাৎস্কি, তার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়া এড়িয়ে যাচ্ছে। সেটাই ছিল সেখানে তার শেষ সন্ধ্যা। তার উচিত ছিল না খেলে ভরন্তসভদের তাঁবুতে যাওয়া। তারাই তাকে দাওয়াত দিয়েছিল, তাহলে সবকিছুই ঠিক থাকত। এখন সবকিছু ঠিক তো নয়ই, ভয়ংকর হয়ে গিয়েছে।
বন্ধু ও পরিচিতদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি ফিরে সোজা বিছানায়। ঘুমাল টানা আঠারো ঘণ্টা। খুব বড় হারের পর এমন ঘুমানোই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে আসা কসাক সৈন্যটিকে বখশিশ দিতে পঞ্চাশ কোপেক ধার নেওয়ায় আর তার বিধ্বস্ত চেহারা ও সংক্ষিপ্ত জবাব থেকে মেরি দমিত্রিয়েভনা আন্দাজ করতে পারছিল সে জুয়ায় অনেক টাকা হেরেছে। মেরি খেপে গেল মেজরের ওপর, কেন সে ছুটি দিয়েছিল।
পরদিন দুপুরে ঘুম ভাঙল বাটলারের। মনে পড়ল তার অবস্থা। সে আবার বিস্মরণে ডুবে যেতে চাইল, যা থেকে কেবলই উঠেছে। কিন্তু সেটা ছিল অসম্ভব। অপরিচিত লোকটির কাছে ঋণের চার শ সত্তর রুবল শোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। তার প্রথম পদক্ষেপ ভাইয়ের কাছে চিঠি লেখা। দোষ স্বীকার করে অনুনয় করল শেষবারের মতো পাঁচ শ রুবল ধার দেওয়ার। তাদের যৌথ মালিকানার কারখানায় তার অংশ বন্ধক রেখে। তারপর চিঠি লিখল তাদের এক কিপটে আত্মীয়কে। যেকোনো সুদেই হোক পাঁচ শ রুবল ধার চাইল সেই মহিলার কাছে। তারপর সে গেল মেজরের কাছে। সে জানত মেজরের, অর্থাৎ মেরি দমিত্রিয়েভনার কিছু টাকা আছে। পাঁচ শ রুবল ধার চাইল সে।
আমি তোমাকে এক্ষুনি দেব, কিন্তু মারিয়া দেবে না! বলল মেজর। মেয়েদের মুঠো এমন শক্ত, কোন শয়তান তাদের বুঝতে পারে?…কিন্তু তোমার তো একটা উপায় করতে হবে!…ওই পাষাণ ক্যানটিনওয়ালার কাছে কিছু নেই?
ক্যানটিনওয়ালার কাছে ধার চাওয়ার কোনো মানে নেই। তাই বাটলারের মুক্তি আসতে পারে একমাত্র উপায় ভাইয়ের বা কিপটে আত্মীয়ের কাছ থেকে।
২২
চেচনিয়ায় উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় হাজি মুরাদ তিবলিসে ফিরে আসেন। সেখানে প্রতিদিন ভরসভের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করতে থাকেন। কখনো দেখা পেলে ভাইসরয়ের কাছে অনুনয় করেন সব পাহাড়ি বন্দীকে এক জায়গায় এনে তার পরিবারের সঙ্গে বিনিময় করার জন্য। তিনি বলেন, সেটা না করা পর্যন্ত তার হাত বাঁধা। শামিলকে ধ্বংস করার জন্য তিনি রুশদের সাহায্য করতে চান, কিন্তু পারছেন না। ভরন্তসভ ভাসা-ভাসা কথা দেন, তিনি যা পারবেন করবেন। এই বলে তা থামিয়ে দেন। বলেন। জেনারেল আরগুতিনস্কি তিবলিসে পৌঁছালে বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলবেন।