হাজি মুরাদ ভুরু কুঁচকালেন। প্রতিটি জাতির নিজেদের রীতি আছে! আমাদের মেয়েরা ওই রকম পোশাক পরে না, মেরি দমিত্রিয়েভনার দিকে চোখ ফেলে তিনি বললেন।
তার কি তা ভালো লাগেনি?
আমাদের একটা প্রবাদ আছে, হাজি মুরাদ দোভাষীকে বললেন, কুকুর গাধাকে মাংস দিল, গাধা কুকুরকে খড় দিল এবং দুজনেই না খেয়ে থাকল, তিনি হাসলেন। সব জাতিরই নিজেদের রীতি ভালো লাগে।
কথা আর এগোল না। অফিসাদের কেউ কেউ চা নিলেন। কেউ কেউ খাবার নিলেন। হাজি মুরাদ তাকে দেওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে তার সামনে নামিয়ে রাখলেন।
আপনি মাখন দিয়ে একটা বান খাবেন? মেরি দমিত্রিয়েভনা তাকে জিজ্ঞেস করল।
হাজি মুরাদ সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন।
তাহলে, বিদায় নিতে হবে! তার হাঁটু ছুঁয়ে বলল বাটলার। আবার কবে দেখা হবে?
বিদায়, বিদায়, মৃদু হেসে রুশ ভাষায় বললেন হাজি মুরাদ। বিদায় বন্ধু। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব দৃঢ় হোক! যাওয়ার সময় হয়েছে? বলে যে পথে যেতে হবে, হাজি মুরাদ সেদিকে ঘাড় কাত করলেন।
এলডার দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কাঁধে সাদা একটা জিনিস আর হাতে তলোয়ার। হাজি মুরাদ ইশারা করে তাকে কাছে ডাকলেন। এলডার লম্বা পা ফেলে তার কাছে এসে সাদা চাদর আর তলোয়ারটা দিল। হাজি মুরাদ দাঁড়িয়ে চাদরটা হাতে নিয়ে দোভাষীকে কিছু বলে সেটা মেরি দমিত্রিয়েভনাকে দিলেন।
দোভাষী বলল, তিনি বলছেন তুমি চাদরটার প্রশংসা করেছ, তাই এটা নাও।
ওহ্, কেন? লজ্জা পেয়ে বলল মেরি দমিত্রিয়েভনা।
এটা দরকার। আদত, আমাদের রীতি, বললেন হাজি মুরাদ।
বেশ, আপনাকে ধন্যবাদ, চাদরটা হাতে নিয়ে বলল মেরি দমিত্রিয়েভনা। ঈশ্বর করুক যেন আপনার ছেলেকে মুক্ত করতে পারেন, সে বলল। তাকে বলো তার ছেলেকে মুক্ত করায় আমি তার সাফল্য কামনা করছি।
হাজি মুরাদ মেরি দমিত্রিয়েভনার দিকে তাকিয়ে সম্মতিতে মাথা নাড়লেন। তারপর এলডারের কাছ থেকে তলোয়ারটি নিয়ে সেটা মেজরকে দিলেন। সেটা নিয়ে মেজর দোভাষীকে বলল, তাকে আমার বাদামি ঘোড়াটা নিতে বলো। তাকে দেওয়ার মতো আমার আর কিছু নেই।
হাজি মুরাদ মুখের সামনে হাত নেড়ে বোঝালেন কিছুই চাই না এবং নেবেন না। তারপর পাহাড়ের দিকে, পরে নিজের বুকে হাত দেখিয়ে বের হয়ে গেলেন।
সবাই দরজা পর্যন্ত তার পিছু পিছু এল। ঘরের ভেতরে রয়ে যাওয়া অফিসাররা খাপ থেকে তলোয়ারটা বের করে পরখ করল, ওটা ছিল খাঁটি গুরদা (নামের) অত্যন্ত দামি তলোয়ার।
বাটলার হাজি মুরাদের সঙ্গে গাড়িবারান্দা পর্যন্ত গেল, তখনই খুব অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনা ঘটে গেল, যাতে চারদিকে তার নজর, দৃঢ়তা আর ক্ষিপ্রতা না থাকলে হাজি মুরাদ মারা যেতে পারতেন।
কুমুখ এলাকার গ্রাম তাশ-কিচুর বাসিন্দারা রুশদের বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। তারা হাজি মুরাদকে শ্রদ্ধা করত। তাই শুধু বিখ্যাত নায়েবকে দেখার জন্য তারা দুর্গে আসত। তিন দিন আগে তারা বার্তাবাহক পাঠিয়ে তাকে শুক্রবার মসজিদে যাওয়ার দাওয়াত দেয়। কিন্তু তাশ-কিচুর কুমুখ প্রিন্সরা জ্ঞাতিবৈরিতার জন্য হাজি মুরাদকে দেখতে পারত না। তাকে দাওয়াত দেওয়ার কথা শুনে তারা ঘোষণা করে যে হাজি মুরাদকে তারা মসজিদে ঢুকতে দেবে না। বাসিন্দারা এত উত্তেজিত হয়ে যায় যে প্রিন্সদের লোকজনের সঙ্গে বাসিন্দাদের লড়াই লেগে যায়। রুশ কর্তৃপক্ষ পাহাড়িদের শান্ত করে এবং হাজি মুরাদকে মসজিদে যেতে নিষেধ করে খবর পাঠায়।
হাজি মুরাদ মসজিদে যাননি এবং সবাই ভেবেছিলে ব্যাপারটা মিটে গেছে।
কিন্তু বিদায়ের সময় হাজি মুরাদ গাড়িবারান্দায় আসেন। ঘোড়াগুলো সেখানে রাখা ছিল। কুমুখ প্রিন্সদের একজন, বাটলার ও মেজরের পরিচিত আরসালান খান, বাড়ির সামনে এসে অপেক্ষা করতে থাকে।
হাজি মুরাদকে দেখে সে বেল্ট থেকে পিস্তল বের করে তার দিকে তাক করে। খোঁড়া হওয়া সত্ত্বেও সে গুলি করার আগেই হাজি মুরাদ বিড়ালের মতো আরসালানের দিকে ছুটে যান। আরসালান গুলি করলে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
আরসালানের ঘোড়ার লাগাম এক হাতে কেড়ে নিয়ে হাজি মুরাদ তার ছোরা বের করে চিৎকার করে আরসালানকে তার ভাষায় কিছু বলেন।
বাটলার আর এলড়ার দুজনেই দৌড়ে দুই শত্রুর কাছে এসে তাদের হাত ধরে ফেলে। গুলির শব্দ শুনে মেজর বের হয়ে এসেছিলেন।
এসব কী আরসালান–আমার বাড়িতে এসে ভয়ংকর ঝামেলা শুরু করেছ, ঘটনা শুনে মেজর বলল। এটা ঠিক না, বন্ধু! যুদ্ধক্ষেত্রে তুমি শত্রুর কাছে হেরো না! কিন্তু আমার বাড়িতে এসে তুমি জবাই শুরু করতে পারো না!
আরসালান খান, বেঁটেখাটো কালো গোঁফধারী। ফ্যাকাশে হয়ে ঘোড়া থেকে নামল। হাজি মুরাদের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে মেজরের সঙ্গে বাড়ির ভেতরে গেল। হাজি মুরাদ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মৃদু হেসে ঘোড়াগুলোর দিকে চলে গেলেন।
সে কেন তাকে খুন করতে চেয়েছিল? বাটলার দোভাষীকে জিজ্ঞেস করল।
সে বলছে, এটা তাদের আইন, দোভাষী বাটলারকে দেওয়া হাজি মুরাদের উত্তর বুঝিয়ে দিল।
আরসালান কোনো আত্মীয়ের খুনের বদলা নিতে তাকে খুন করার চেষ্টা করে।
পথে যদি আবার দেখা হয়? বাটলারের প্রশ্ন।
হাজি মুরাদ হাসলেন।
বেশ, সে যদি আমাকে খুন করতে পারে, তাহলে সেটাই আল্লাহর ইচ্ছা। বিদায়, ঘোড়ার ঘাড়ে হাত রেখে তিনি আবার রুশ ভাষায় বললেন। তাকে বিদায় জানাতে আসা সবার দিকে তাকালেন এবং তারপর নরম চোখে তাকালেন মেরি দমিত্রিয়েভনার দিকে।