চাদর, রাইফেল ও তলোয়ার খুলে বুড়োর হাতে দিতে দিতে হাজি মুরাদ জবাব দিলেন, আপনার ছেলেরা দীর্ঘজীবী হোক! ঘরটির দেয়াল মাটির আস্তর দেওয়া এবং সাবধানে চুনকাম করা। বুড়ো পরিষ্কার দেয়ালে ঝোলানো দুটো চকচকে বড় গামলার মাঝখানে বাড়ির কর্তার অস্ত্রগুলোর পাশের একটি পেরেকে রাইফেল ও তলোয়ারটি সাবধানে ঝুলিয়ে রাখল।
হাজি মুরাদ তার পিঠের পিস্তলটি নাড়িয়ে ঠিক করে তাকিয়াগুলোর কাছে এসে তার চাপকানটি ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বসে পড়লেন। বুড়ো খোলা গোড়ালি নিয়ে উবু হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে হাত দুটো তুলল মোনাজাতের ভঙ্গিতে। হাজি মুরাদও তাই করলেন। তারপর আবার দোয়া করে দুজনেই হাতের তালু মুখে লাগিয়ে ধীরে ধীরে নামিয়ে দাড়ির শেষ প্রান্তে দুহাত মেলালেন।
নতুন কোনো খবর আছে? বুড়ো লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন হাজি মুরাদ।
না, নতুন কিছু নেই, তার নিষ্প্রাণ চোখ দুটো দিয়ে হাজি মুরাদের মুখের দিকে নয়, বুকের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল বুড়ো। আমি মৌমাছির খামারে থাকি এবং আজই শুধু ছেলেকে দেখার জন্য এসেছি…সে জানে।
হাজি মুরাদ বুঝতে পারলেন, বুড়ো যা জানে এবং হাজি মুরাদ যা জানতে চান, তা বলতে চাচ্ছে না, তাই আলতো করে মাথা নাড়িয়ে তাকে। আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।
কোনো ভালো খবর নেই, বলল বুড়ো। একটাই খবর হলো খরগোশগুলো আলোচনা করছে ইগলগুলোকে কীভাবে তাড়ানো যায়; আর ইগলগুলো প্রথমে একটাকে ছিঁড়ে খায়, তারপর তাদের আরেকটাকে। আরেক দিন রাশিয়ার কুকুরগুলো মিচিত গ্রামে খড়ে আগুন দিয়েছে…ওদের মুখগুলো পুড়ুক! রেগে কর্কশ গলায় সে বলল।
মাটির মেঝেয় আস্তে তার সবল পা ফেলে হাজি মুরাদের মুরিদ ঘরে ঢুকল, তার ছোরা আর পিস্তলটা রেখে চাদর, রাইফেল আর তলোয়ার খুলে হাজি মুরাদের অস্ত্রগুলো যে পেরেকে লটকানো ছিল, সেটাতেই ঝুলিয়ে দিল।
নবাগতের দিকে দেখিয়ে বুড়ো জিজ্ঞেস করল, এ কে?
আমার মুরিদ। নাম এলডার, জবাব দিলেন হাজি মুরাদ।
খুব ভালো, এই কথা বলে বুড়ো তাকে হাজি মুরাদের পাশে একটুকরো কম্বলে বসার ইশারা করল। এলডার আসন করে বসে তার ভেড়ার চোখের মতো সুন্দর চোখ দিয়ে ততক্ষণে কথা বলতে শুরু করা বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকল। বুড়ো বলছিল কী করে তাদের সাহসী বন্ধুরা আগের সপ্তাহে দুজন রুশ সেনাকে ধরে ফেলে এবং একজনকে মেরে ফেলে আর অন্যজনকে ভেদেনোয় শামিলের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
হাজি মুরাদ তার কথা মন দিয়ে শুনছিলেন না, বাইরে কিছু আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বারান্দায় পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল, দরজাটা ক্যাচ কাঁচ করে উঠল আর ঘরে ঢুকল বাড়ির কর্তা সাদো। তার বয়স প্রায় চল্লিশ, অল্প দাড়ি, খাড়া নাক এবং তাকে বাড়িতে ডেকে আনতে তার পনেরো বছরের যে ছেলেটি গিয়েছিল, তার মতোই কালো চোখ, তবে তত উজ্জ্বল নয়, ছেলেটিও বাবার সঙ্গে ঘরে ঢুকে বসল দরজার পাশে। বাড়ির কর্তা তার খড়ম খুলে রেখেছে চৌকাঠের কাছে, তারপর তার পুরোনো অসংখ্যবার পরা টুপিটা মাথার পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে (অনেক দিন কামানো হয়নি বলে মাথার কালো চুল বড় হয়ে গেছে) হুট করে উবু হয়ে বসল হাজি মুরাদের সামনে।
বুড়োর মতো করে মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত উঠিয়ে দোয়া পড়ে সে-ও হাত দুটো মুখের ওপর থেকে দাড়ির প্রান্ত পর্যন্ত নামিয়ে আনল। দোয়া পড়া শেষ হলেই কেবল সে কথা বলতে শুরু করল। সে বলল কেমন করে শামিলের কাছ থেকে হাজি মুরাদকে জীবিত বা মৃত ধরার আদেশ এসেছে; শামিলের চরেরা আগের দিনই ঘুরে গেছে, লোকেরা শামিলের অবাধ্য হতে ভয় পাচ্ছে এবং তাই সাবধান হওয়া দরকার।
আমার বাড়িতে, সাদো বলল, আমি জীবিত থাকতে কেউ আমার অতিথির কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু ভোলা মাঠে কী হবে?…আমাদের এটা ভাবতে হবে।
হাজি মুরাদ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন আর মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন। সাদোর কথা শেষ হলে তিনি বললেন, বেশ, আমরা তাহলে একটা লোককে দিয়ে রুশদের কাছে একটা চিঠি পাঠাব। আমার মুরিদ যাবে, কিন্তু তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন লোক লাগবে।
আমি বাটা ভাইকে দিয়ে দেব, সাদো বলল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে ছেলেকে বলল, যা তো, বাটাকে ডেকে নিয়ে আয়।
ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল যেন তার পায়ে স্প্রিং লাগানো, তারপর হাত দুলিয়ে ছুটে কুঁড়ে থেকে বের হয়ে গেল। মিনিট দশেক পর সে ফিরে এল একজন খাটো পায়ের পেশিবহুল চেচেনকে সঙ্গে নিয়ে, রোদে পুড়ে তার শরীর প্রায় কালো, গায়ে পুরোনো টুটাফাটা হলুদ চাপকান, যার হাতার কিছু অংশ খসে পড়েছে, আর পরনে দলামোচড়া কালো আঁটসাঁট পাতলুন।
হাজি মুরাদ আগতকে সালাম দিলেন এবং আর একটা কথাও না বলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমার মুরিদকে রুশদের কাছে নিয়ে যেতে পারবে?
আমি পারব, সোৎসাহে উত্তর দিল বাটা। আমি নিশ্চয়ই পারব। আর কোনো চেচেন নেই যে আমার মতো পার হতে পারবে। অন্য কেউ হয়তো যেতে রাজি হবে, যে কোনো ওয়াদা করবে কিন্তু কাজ কিছুই পারবে না; আমিই করতে পারব!
ঠিক আছে, হাজি মুরাদ বললেন। তিনটি আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন, তোমার কষ্টের জন্য তিন রুবল পাবে।
বাটা মাথা নাড়িয়ে জানাল সে বুঝতে পেরেছে এবং বলল যে সে টাকার জন্য লোভী নয়, কাজটা সে করছে শুধু হাজি মুরাদের কাজ করতে পারার সম্মানের জন্য। পাহাড়ের সবাই হাজি মুরাদ সম্বন্ধে জানত এবং জানত সে কীভাবে রুশ শুয়োরকে জবাই করেছে।