সেটাই ভালো হয়! মেরি দমিত্রিয়েভনা আবার কাজে লেগে গেল।
হাজি মুরাদ তার বাড়িতে এসেছে শুনে মেজর আইভান মাতভিয়েচ পেত্ৰভ একটুও অবাক হয়নি। সে জানত হাজি মুরাদ গ্রজনিতে। বিছানায় উঠে বসে সে একটা সিগারেট ধরিয়ে পোশাক পরতে শুরু করল। জোরে গলাখাকারি দিয়ে শয়তানটাকে তার কাছে পাঠানোর জন্য গজগজ করল।
তৈরি হয়ে সে আরদালিকে একটু ওষুধ দিতে বলল। আরদালি জানত ওষুধ মানে ভোদকা, নিয়ে এল সে।
মিশিয়ে মদ খাওয়ার মতো খারাপ কিছু নেই, বিড়বিড় করে সে ভোদকাটা সেঁক দিয়ে এক কামড় রাইয়ের রুটি খেল! কাল চিখির খেয়েই মাথাটা ধরেছে…এখন কাজে যেতে হচ্ছে, বলতে বলতে বসার ঘরে গেল। হাজি মুরাদ আর অফিসারটাকে বাটলার সেখানে এনে বসিয়েছে।
অফিসার লেফট ফ্ল্যাঙ্কের কমান্ডারের আদেশটা মেজরের হাতে দিল। তাতে হাজি মুরাদকে তার কাছে রেখে চরদের মাধ্যমে পাহাড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই যেন কসাকদের একটা দল সঙ্গে না নিয়ে তাকে দুর্গের বাইরে যেতে দেওয়া না হয়।
কাগজটা পড়ে মেজর হাজি মুরাদের দিকে তাকাল এবং আবার কাগজটা খুঁটিয়ে দেখল। এভাবে কয়েকবার এদিক-ওদিক চোখ ফেলে শেষে হাজি মুরাদের দিকে তাকাল।
ঠিক আছে, স্যার, ঠিক আছে! উনি এখানেই থাকুন। তাকে বলে দেন যে তাকে বাইরে যেতে না দেওয়ার আদেশ আছে। সেটা মানতে হবে! বাটলার, ওনাকে কোথায় থাকতে দেওয়া যায়? অফিস ঘরে?
বাটলার জবাব দেওয়ার আগেই মেরি দমিত্রিয়েভনা রান্নাঘর থেকে এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে মেজরকে বলল, কেন তাকে এখানে রাখবে! তাকে মেহমানদের ঘর আর ভাড়ার ঘরটা দেব। তাতে তার ওপর চোখ রাখা যাবে, হাজি মুরাদের দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল মেরি। চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ ঘুরিয়ে নিল।
মেরি দমিত্রিয়েভনা ঠিক বলেছে, বলল বাটলার।
ঠিক আছে, ঠিক আছে; যাও! মেয়েদের এখানে কোনো কাজ নেই, ভুরু কুঁচকে বলল মেজর।
কথাবার্তার পুরো সময়টা হাজি মুরাদ ছোরার বাটে হাত রেখে বসে ছিল। ঠোঁটে তার মৃদু অবজ্ঞার হাসি। তিনি বললেন, যেখানেই রাখা হোক, তার কাছে সবই সমান, সরদার যা কিছুর অনুমতি দিয়েছে, তার বেশি তার চাই না। পাহাড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অনুমতি আছে। তাই তাদের যেন এখানে আসতে দেওয়া হয়।
মেজর বলল তা করা হবে। আর বাটলার যেন তাদের কিছু খাবার দিতে এবং ঘরগুলো গুছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। সে এর মধ্যে অফিসে গিয়ে দরকারি কাজগুলো করবে আর আদেশ দেবে।
নতুন লোকদের সঙ্গে হাজি মুরাদের সম্পর্ক কী হবে, তা সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে গেল। শুরু থেকেই তিনি মেজরের ব্যবহারে বিরক্ত। তাই তিনি ত্যাড়াভাবে কথা বলেছেন। মেরি দমিত্রিয়েভনা রান্না করে খাবার দিয়ে গেল। তাকে তিনি পছন্দ করেছেন। তার সারল্য, বিশেষ করে বিদেশি ধরনের সৌন্দর্য তার ভালো লেগেছে। হাজি মুরাদের প্রতি আকর্ষণ নিজের অজান্তেই সে বুঝিয়ে দেওয়ায় হাজি মুরাদ বশীভূত। হাজি মুরাদ তার দিকে তাকাতে বা তার সঙ্গে কথা না বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ দুটো মেরির চলাফেরার পথেই ঘুরেছে। দেখা হওয়ার মুহূর্ত থেকে বাটলারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গে অনেক কথা বলেছেন তার জীবন সম্বন্ধে, নিজের জীবন সম্বন্ধে। গুপ্তচরেরা তার পরিবার সম্পর্কে যে খবর এনেছে, সেগুলো বলেছেন। এমনকি নিজের কী করা উচিত, তাই নিয়ে বাটলারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।
চরদের মাধ্যমে তিনি ভালো খবর পাননি। দুর্গে তার প্রথম চার দিনে। তারা দুবার তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। দুবারই তারা খারাপ খবর আনে।
১৯
হাজি মুরাদ রুশদের কাছে পালিয়ে যাওয়ার পরপর তার পরিবার ভিদেনোয় নিয়ে যাওয়া হয়। শামিল কী ঠিক করে, সে জন্য তাদের পাহারায় রাখা হয়েছে। তার মা ফাতিমা এবং দুই স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান অফিসার ইব্রাহিম রশিদের বাড়িতে পাহারায়। হাজি মুরাদের আঠারো বছর বয়সী ছেলে ইউসুফ কারাগারে বন্দী। কারাগার মানে সাত ফুটের বেশি গভীর একটি গর্ত। ইউসুফ রয়েছে আরও সাতজনের সঙ্গে। তারা সবাই ভাগ্যে কী ঘটে, তার জন্য অপেক্ষা করছে।
সিদ্ধান্ত দিতে দেরির কারণ শামিল গেছেন রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।
যুদ্ধের পর ভিদেনোয় তিনি ফিরে এলেন ১৮৫২ সালের ৬ জানুয়ারি। রুশরা বলছে, যুদ্ধে হেরে তিনি ভিদেনোয় পালিয়ে গেছেন। আর শামিল ও মুরিদরা বলছে, তারাই রুশদের ঠেকিয়ে দিয়ে জয়ী। ওই যুদ্ধে শামিল নিজে রাইফেল চালান। সেটা তিনি করেন খুব কম। তলোয়ার নিয়েও তিনি রুশদের সরাসরি তাড়া করেন। মুরিদরা তাকে বাধা দেয়। শামিলের পাশেই তার দলের দুজন সেখানেই মারা যায়।
শামিল ফিরে আসেন দুপুরের দিকে। মুরিদরা তাকে ঘিরে ধ্বনি দিতে দিতে আসছিল। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। শামিলের বাড়ি পৌঁছা পর্যন্ত তারা অনবরত রাইফেল ও পিস্তলের গুলি ফোঁটাতে থাকে।
বড় গ্রামটির সব বাসিন্দা তাদের নেতাকে দেখার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিল। অনেকে নিজেদের রাইফেল ও পিস্তল থেকে গুলি ছুড়ছিল বিজয়ের উত্তেজনায়। শামিল একটা আরবি সাদা ঘোড়ায় আসছিলেন। তার বাড়ির কাছাকাছি আসায় ঘোড়াটা চলছিল নিজের ইচ্ছায়। ঘোড়াটার জিন বা লাগাম ছিল খুব সাধারণ, কোনো সোনা-রুপা লাগানো ছিল না। সূক্ষ্ম কারুকাজ করা লাল চামড়ার চাবুকটার মাঝবরাবর টানা দাগ। ধাতুর পাদানিগুলো কাপের মতো দেখতে। লাল চাদরের নিচ থেকে জিনটার কিছুটা দেখা যাচ্ছিল। ইমাম পরেছিলেন এক পরত কালো পশম লাগানো বাদামি সুতির চাদর। ঘাড় ও হাতের কাছে পশমগুলো দেখা যাচ্ছিল। তার চিকন লম্বা কোমরে একটা কালো ফিতে দিয়ে চাদরটা বাঁধা। তাতে গাথা