গ্রামের বাসিন্দারা দ্বিধাগ্রস্ত। এত দিন এত পরিশ্রম দিয়ে গড়ে তোলা গ্রামটির ওপর বিবেকহীন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে আবারও এমন হামলা হতে পারে। তা সত্ত্বেও তারা সেখানে থেকেই গ্রামটা মেরামত করবে, নাকি মনের বিকার ও অপমান সয়ে নিয়ে তাদের ধর্মীয় নির্দেশনা না মেনে রুশদের বশ্যতা স্বীকার করবে। বয়স্করা নামাজ পড়ে দোয়া করল। তারপর সবাই একমত হয়ে সাহায্য চেয়ে শামিলের কাছে দূত পাঠাল এবং তারা ধ্বংস করা সবকিছু মেরামত শুরু করল।
১৮
আক্রমণের পরের সকালে, খুব ভোরে নয়, বাটলার পেছনের গাড়িবারান্দা দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। নাশতার আগে তাজা বাতাসে একটু হেঁটে আসবে ভেবে। সাধারণত পেত্রভের সঙ্গেই সে যায়। সূর্য ইতিমধ্যে পাহাড়গুলোর ওপরে উঠে গেছে। রাস্তার ডান দিকের আলোয় উজ্জ্বল সাদা দেয়ালগুলোর দিকে তাকালে চোখ ব্যথা করছে। অথচ সব সময়ের মতো চোখ জুড়িয়ে যায় বাঁ পাশের দেয়ালগুলোর দিকে বা পেছনে অন্ধকার কমে আসা বনে ঢাকা উঁচু পাহাড়ের দিকে বা মেঘের ভান করা বরফের চূড়াগুলোর আবছা রেখার দিকে তাকালে। বাটলার পাহাড়গুলোর দিকে তাকাল। নিশ্বাস নিল বুক ভরে আর বেঁচে আছে বলে এবং এই সুন্দর জায়গায় আছে বলে তার আনন্দ হলো।
গতকাল যাওয়া-আসার দুবারই, বিশেষ করে খুব গরমের মধ্যে পিছিয়ে আসার সময়, সে এত ভালো ব্যবহার করেছে ভেবে সে মনে মনে খুশি ছিল। ফিরে আসার পর পেত্রভের রক্ষিতা মাশা (বা মেরি দমিত্রিয়েভনা) যেভাবে প্রত্যেককে যত্ন করে রাতের খাবার দিয়েছে, তাতেও সে খুশি। তার মনে হয়েছে, মাশা তাকে একটু বেশিই যত্ন করেছে।
মেরি দমিত্রিয়েভনার মোটা বেণি, চওড়া কাঁধ, বিশাল বক্ষ এবং গোলাপি তিলে ভরা মুখে উদ্ভাসিত হাসি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাটলারকে আকর্ষণ করে। অবিবাহিত সুঠাম যুবক বাটলারের এমনও মনে হয়েছে যে মাশা তাকে কামনা করে। কিন্তু সে মনে করে, সেটা তার সরল ভালোমানুষ সহকর্মীর প্রতি অন্যায় হবে। তাই সে মাশার প্রতি সম্মান দেখাত এবং সেটা করতে পারায় নিজের ওপর খুশি ছিল।
এই চিন্তায় তার মগ্নতা ভেঙে গেল সামনের ধুলোভরা রাস্তাটায় অনেকগুলো ঘোড়ার খুরের আওয়াজে। মনে হলো বেশ কয়েকজন ঘোড়সওয়ার আসছে। সে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল রাস্তার শেষ মাথায় একটা দল তার দিকে হেঁটে আসছে। জনা বিশেক কসাকের সামনে দুজন অশ্বারোহী। একজনের পরনে একটা সাদা চাপকান, মাথায় লম্বা পাগড়ি। অন্যজন রুশ অফিসার, গাঢ় গায়ের রং। ইগলের ঠোঁটের মতো নাক। তার পোশাক ও অস্ত্রে অনেক রুপার পদক। পাগড়ি পরা লোকটার ঘোড়াটির রং চমৎকার বাদামি, কেশর আর লেজের রং একটু হালকা। ওটার মাথাটা ছোট, সুন্দর চোখ। অফিসারটির ঘোড়া একটা বড় সুদর্শন কারাবাখ। ঘোড়াপ্রেমিক বাটলার তক্ষুনি প্রথম ঘোড়াটার শক্তি বুঝতে পারল। লোকগুলো কারা, দেখার জন্য সে দাঁড়াল।
এটা কমান্ডারের বাসা? জিজ্ঞেস করল অফিসারটি। উচ্চারণ আর শব্দগুলো প্রতারণা করে তার বিদেশি পরিচয় ফাঁস করে দিল।
হ্যাঁ, বলে বাটলার অফিসারটির কাছে এসে পাগড়ি পরা লোকটিকে দেখিয়ে জানতে চাইল, ইনি কে?
ইনি হাজি মুরাদ। কমান্ডারের সঙ্গে থাকবেন বলে এসেছেন। অফিসারটি বলল।
বাটলার হাজি মুরাদ সম্বন্ধে এবং রাশিয়ার কাছে তার আত্মসমর্পণের খবর জানত। কিন্তু তাকে ছোট্ট দুৰ্গটায় দেখার আশা করেনি। হাজি মুরাদ তার দিকে বন্ধুত্বের দৃষ্টিতে তাকালেন।
সুপ্রভাত, কটকিল্ডি। তার শেখা তাতারি ভাষায় স্বাগত জানানোর শব্দটা বলল বাটলার।
সবুল! (ভালো থাকুন!) হাজি মুরাদের জবাব। ঘোড়াটি বাটলারের কাছে নিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে। হাতটার দুই আঙুলে তার চাবুকটা ঝুলছিল।
আপনিই কি সেনাপ্রধান? সে জিজ্ঞেস করল।
না, সেনাপ্রধান ভেতরে। আমি তাকে ডেকে আনছি, অফিসারটিকে এই কথা বলে বাটলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দরজায় ধাক্কা দিল। অতিথিদের দরজাটা বন্ধ ছিল। মেরি দমিত্রিয়েভনা ওটাকে তা-ই বলত। কয়েকবার ধাক্কা দেওয়া সত্ত্বেও দরজাটা কেউ না খোলায় বাটলার ঘুরে পেছনের দরজায় গিয়ে নিজের আরদালিকে ডাকল। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। দুই আরদালির কাউকে না পেয়ে সে গেল রান্নাঘরে। সেখানে ছিল মেরি দমিত্রিয়েভনা। তার আস্তিন কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত গুটিয়ে মোটা সাদা হাত দিয়ে হাতের মতোই সাদা ময়দা মাখিয়ে ছোট ছোট পিণ্ড করে রাখছে। ওগুলো দিয়ে পাই বানাবে।
আরদালিরা কোথায়? জিজ্ঞেস করল বাটলার।
মদ খেতে গেছে। তুমি কী চাও? জিজ্ঞেস করল মেরি দমিত্রিয়েভনা।
সামনের দরজা খুলতে হবে। তোমার বাড়ির সামনে একদল পাহাড়ি। হাজি মুরাদ এসেছে!
অন্য কিছু বানিয়ে বলো! হেসে বলল মেরি দমিত্রিয়েভনা।
ঠাট্টা না, সে আসলেই গাড়িবারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে!
সত্যি বলছ?
তোমার সঙ্গে শয়তানি করব কেন? গিয়ে দেখে এসো সে গাড়িবারান্দায়!
হায় খোদা, ঝামেলা হলো তো! আস্তিন নামিয়ে তার মোটা বেণিতে কাঁটাগুলো ঠিক আছে কি না দেখল। আর বলল, আমি তাহলে আইভান মাতভিয়েচকে তুলে দিই।
না, আমিই যাই। বন্দারেঙ্কো, দরজাটা খুলে দাও! পেত্রভের আরদালি তখনই এসেছিল। তাকে বলল বাটলার।