বুঝেছেন, স্যার! দুই গানের ফাঁকে বাটলার তার উধ্বর্তন মেজরকে বলল, এটা পিটার্সবার্গের মতো আইস রাইট, আইস লেফট নয়। এখানে আমরা আমাদের কাজ করে এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। মাশা আমাদের পাই আর সুন্দর বাঁধাকপির স্যুপ খেতে দেবে। এটাই জীবন। তাই না স্যার? তাহলে এবার ভোরের সূর্য উঠছে বলে গানটা হোক! পছন্দের গানটি গাইতে বলল বাটলার।
বাতাস তাজা ও পরিষ্কার, কোনো গতি নেই। এতটা স্বচ্ছ যে এক শ মাইল দূরের বরফঢাকা পাহাড়কেও মনে হয় এই কাছেই। দুই গানের ফাঁকে ফাঁকে পায়ে চলার শব্দ আর কামানের ধাতব ঝংকার আবহ সংগীতের মতো মনে হচ্ছিল। বাটলারের কোম্পানিতে যে গানটি গাওয়া হচ্ছিল, সেটি লিখেছিল একজন নবিশ সৈন্য। সবার চেয়ে আলাদা পদাতিক পদাতিক! নাচের ছন্দে সেটার সুর। বাটলার তার ঘোড়া নিয়ে ঠিক তার ওপরের পদের অফিসারটির পাশে চলে এল। মেজর পেত্রভের সঙ্গেই সে থাকত। বাটলারের মনে হলো, দেহরক্ষী বাহিনী থেকে ককেশাসে আসতে পারার জন্য সে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ হয়নি। তার বদলি হওয়ার মূল কারণ সে তার সবকিছু তাসের জুয়ায় উড়িয়ে দেয়। তাই সে ভয় করছিল তার আর হারানোর মতো কিছু না থাকলেও সে তাসের নেশা কাটাতে পারবে না। এখন সেগুলো আর নেই, আনন্দ আর সাহসে তার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে! ভুলে গেছে যে সে ধ্বংস হয়ে গেছে, ভুলে গেছে শোধ না করা ঋণের কথা। ককেশাস, যুদ্ধ, সৈন্যরা, অফিসারবৃন্দ, আধা মাতাল-সাহসী-ভদ্রলোকেরা, মেজর পেভ নিজে–সবকিছুই তার ভালো লাগে। কোনো কোনো সময় এত ভালো লাগে যে সে পিটার্সবার্গে নেই, এটা সত্যি মনে হয় না। পিটার্সবার্গের সেই তামাকের ধোয়াভরা ঘর, জুয়ায় তাসের কোনা উঁচিয়ে দেখা, হিসাব রাখার লোকটাকে ঘেন্না করা, মাথায় চাপ ধরা ব্যথা আর নেই। সে আসলেই সাহসী ককেশীয়দের বিখ্যাত এলাকায়।
মেজর ও সার্জনের আরদালির মেয়ে একসঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকে। মেয়েটিকে আগে মাশা ডাকা হতো, এখন সম্মান দেখিয়ে মেরি দমিত্রিয়েভনা ডাকতে হয়। মেরি দমিত্রিয়েভনা সুন্দরী, মুখে অনেক হালকা বাদামি তিল, সুন্দর চুল। ত্রিশ বছর বয়সী, নিঃসন্তান। অতীত তার যা-ই হোক, সে এখন মেজরের বিশ্বস্ত সহচরী, তাকে সেবিকার মতো যত্ন করে। এটা খুব দরকার। কারণ, মেজর প্রায়ই পান করে মাতাল হয়ে যায়।
দুর্গে পৌঁছা পর্যন্ত সবকিছু মেজরের পরিকল্পনামতোই ঘটল। মেজর, বাটলার ও সেনাদল থেকে আমন্ত্রিত দুজন অফিসারকে পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবার খেতে দিল মেরি দমিত্রিয়েভনা। মেজর মাতাল হওয়া পর্যন্ত খেয়ে আর পান করে ঘরে চলে গেল। বাটলার পাল্লা দেওয়ার চেষ্টায় মাত্রার বেশি চিখির মদ খেয়ে শোবার ঘরে। পোশাক ছাড়ার সময় না পেয়ে তার সুন্দর কোকড়া চুলে ভরা মাথার নিচে হাত রেখে স্বপ্নহীন টানা গভীর ঘুমে ডুবে গেল।
১৭
যে গ্রামটি ধ্বংস করা হয়েছিল, রুশদের কাছে আত্মসমর্পণ করার আগের রাতে হাজি মুরাদ ছিল সেখানেই। রুশ সেনাদলের আক্রমণের মুখে সাদো তার পরিবার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। ফিরে এসে সে দেখল, তার বাড়িটি ধ্বংস হয়ে গেছে। ছাদটি ভেঙে পড়েছে, বারান্দার খুঁটিগুলো পোড়া আর ভেতরে ধ্বংসস্তূপ। তার উজ্জ্বল চোখের সুদর্শন ছেলেটিকে, যে উত্তেজনাভরে হাজি মুরাদের দিকে অপলক তাকিয়েছিল, চাদর দিয়ে ঢেকে ঘোড়ার পিঠে করে মসজিদে আনা হয়েছে। পিঠে বেয়নেটের আঘাতে তাকে মারা হয়েছে। যে সম্মানিতা মহিলা তার বাড়িতে হাজি মুরাদের সেবা করেছিলেন, তিনি তার ছেলের মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে। পরনের ঘন কুঁচি দেওয়া জামাটি ছিঁড়ে গেছে। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বৃদ্ধার শুকনো স্তন। চুল ঝুলে আছে নিচের দিকে। নখের আঁচড়ে মুখ থেকে ঝরছে রক্ত। অবিরাম বিলাপ করে তিনি কাঁদছেন। সাদো খন্তা-কোদাল হাতে আত্মীয়দের নিয়ে ছেলের জন্য কবর খুঁড়তে চলে গেল। বুড়ো দাদা ভাঙা কুঁড়েটির দেয়ালের পাশে বসে আছে। একটি কাঠি কাটছে আর নির্বিকার দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কেবলই মৌমাছির খামার থেকে এল। সেখানে দুটো খড়ের গোলা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সে যে খোবানি (এপ্রিকট) আর লাল জামের (চেরি) চারা লাগিয়েছিল, সেগুলো দুমড়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ খবর হলো সব কটি মৌচাক আর মৌমাছি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের বিলাপ আর মায়েদের সঙ্গে শিশুদের কান্না ক্ষুধার্ত গবাদিপশুর দুর্বল হাম্বার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। পশুগুলোর জন্য কোথাও কোনো খাবার ছিল না। বড় ছেলেমেয়েগুলো খেলছিল না, ভয়ার্ত চোখে বড়দের পিছু পিছু চলছিল। ঝরনার পানি পরিকল্পিতভাবে দূষিত করে দেওয়া হয়েছে, যাতে ব্যবহার করা না যায়। মসজিদটিও একইভাবে নোংরা করে দেওয়া হয়েছে। ইমাম ও তার সহকারীরা তা পরিষ্কার করছেন। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ-সব চেচেনের মনোভাব ঘৃণার চেয়ে বেশি। ঘৃণা নয়; কারণ, তারা রুশ কুত্তাগুলোকে মানুষ বলে মনে করে না। বিবেকহীন নিষ্ঠুরতায় চেচেনদের যে বিকার, বিরক্তি আর বিল অবস্থা, তাতে ওই জীবগুলোকে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে। যেমন ইচ্ছা করে ইঁদুর, বিষধর মাকড় আর নেকড়েকে মারতে। এ রকম ইচ্ছা আত্মরক্ষার মতো সহজাত প্রবৃত্তি।