তখনো শীতকাল। দুপুর হতে চলেছে। খুব ভোরে রওনা করে সেনাদল তিন মাইল হেঁটে এসেছে। সূর্য অনেক ওপরে উঠে তেজি হয়ে যাওয়ায় সৈন্যদের গরম লাগছিল। সূর্যের আলো এত উজ্জ্বল যে বেয়নেটের চকচকে ইস্পাতের ফলার দিকে তাকানো কষ্টকর ছিল। কামানে লাগানো পিতলের ওপর প্রতিফলন ছিল ছোট ছোট সূর্যের মতো। সেদিকে তাকানোও কষ্টকর।
সেনাদলটি টলটলে পানির খরস্রোতা একটি ঝরনা পার হয়ে এসেছে। তাদের সামনে চষা খেত আর ঘাসভর্তি অগভীর খাদ। আরও সামনে অন্ধকার রহস্যময় বনে ঢাকা পাহাড়গুলো। সেগুলোর পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে দুরারোহ পাহাড়। তারও পরে চিরসুন্দর সব সময় রূপ বদলানো সুউচ্চ দিগন্তে আলোর সঙ্গে খেলা করে হিরের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে বরফঢাকা চুড়া।
কালো কোট, লম্বা টুপি আর কাঁধে তলোয়ার নিয়ে ৫ম কোম্পানির সামনে ছিল বাটলার। দেহরক্ষী বাহিনী থেকে আসা লম্বা সুদর্শন অফিসার। বেঁচে থাকার আনন্দ, সেই সঙ্গে মৃত্যুভয়, কিছু একটা করার আগ্রহ আর একক ইচ্ছায় চালিত বিশাল একটা কিছুর অংশ হতে পারার সচেতনতার কারণে সে প্রাণবন্ত। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সে কোনো অভিযানে যাচ্ছে। সে ভাবছিল, কী করে যেকোনো মুহূর্তে তাদের ওপর গুলি চলতে পারে। সে তখন মাথা নিচু করে গুলির শাঁই শাঁই শব্দ শুনবে তো না-ই, বরং তা আগের চেয়ে আরও সোজা রাখবে। চারদিকে তাকিয়ে সহযোদ্ধা আর সৈন্যদের দিকে হাসিমুখে তাকাবে। শান্ত গলায় তাদের সঙ্গে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে গল্প করবে।
সেনাদলটি ভালো রাস্তা ছেড়ে কম ব্যবহৃত রাস্তায় ঘুরে গেল। পথটি গেছে যবের গোড়ায় ভরা খেতের মধ্য দিয়ে। সেটা কখন বনের কাছে নিয়ে এসেছিল, তারা খেয়াল করেনি। শাঁই করে অলক্ষুনে শিস দিয়ে একটা গোলা মালগাড়িগুলোর ভেতর দিয়ে উড়ে গিয়ে রাস্তার পাশের জমি ফাটিয়ে ফেলল।
শুরু হচ্ছে, উজ্জ্বল হাসি মুখে তার পাশে চলা এক সহকর্মীকে বলল বাটলার।
এবং তা-ই হলো। গোলাটার পর বনের আড়াল থেকে ঝান্ডা নিয়ে বের হয়ে এল বিশাল একদল অশ্বারোহী চেচেন। সে দলের মাঝখানে বিরাট একটা সবুজ ঝান্ডা। বাটলার বেশি দূরে দেখতে পেত না। দলের বুড়ো সার্জেন্ট-মেজর অনেক দূরে দেখতে পারত, সে জানাল, শামিল অবশ্যই ওই দলে আছে। অশ্বারোহীরা পাহাড় থেকে বের হয়ে ডান দিকে উপত্যকার সবচেয়ে উঁচু এবং সেনাদলের খুব কাছে চলে এসে নামতে শুরু করল। পুরু কালো কোট আর লম্বা টুপি পরা একজন ছোটখাটো জেনারেল তার দুলকি চালের ঘোড়ায় বাটলারের কোম্পানির কাছে এসে তাকে ডান দিকে নেমে আসা অশ্বারোহীদের আক্রমণ করতে বলল। বাটলার দ্রুত তার কোম্পানি নিয়ে সেদিকে চলে গেল। কিন্তু উপত্যকায় পৌঁছার আগেই তার পেছনে কামান দাগার দুটো আওয়াজ। সে ঘুরে দেখল, দুটো কামানের ওপরে ছাইরং ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওপরে উঠে উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ছে। বোঝা গেল, পাহাড়ি অশ্বারোহীরা গোলন্দাজ বাহিনী আসবে ভাবতে পারেনি। তাই পিছু হটতে থাকে। বাটলারের কোম্পানি তাদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। পুরো গিরিখাদ ভরে গেল বারুদের গন্ধে। খাদের অনেক ওপরে পাহাড়িদের দ্রুত পালাতে দেখা যাচ্ছে। তবু তারা কসাকদের ওপর গুলি চালানো থামায়নি। কোম্পানিটি পাহাড়িদের আরও ধাওয়া করে চলল। দ্বিতীয় উপত্যকাটির ঢালে চোখে পড়ল ছোট্ট একটি গ্রাম।
পাহাড়িদের পিছু ধাওয়া করে বাটলারের কোম্পানি গ্রামটিতে ঢুকে পড়ে। বাসিন্দাদের কেউ সেখানে ছিল না। সৈন্যদের ভুট্টা, খড় ও কুঁড়েগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ার হুকুম দেওয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট গ্রামটি ভরে গেল ঝাঁজালো ধোঁয়ায়। সৈন্যরা কুঁড়েগুলোর ভেতরে যা পেল, টেনে বের করল। মোরগ-মুরগিগুলো ধরল বা গুলি করল। পাহাড়িরা ওগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি।
ধোঁয়া থেকে কিছুটা দূরে বসে অফিসাররা দুপুরের আহার সেরে মদ ও ধূমপান করছিল। সার্জেন্ট-মেজর একটা কাঠের টুকরায় তাদের জন্য একটা মধুর চাক নিয়ে এসেছে। চেচেনদের কোনো পাত্তাই নেই। বিকেল নেমে এলে তাদের চলে যাওয়ার হুকুম দেওয়া হলো। গ্রামটির পেছনে সৈন্যদের সারি। বাটলারের কোম্পানি সবার পেছনে। তারা চলতে শুরু করামাত্র চেচেনরা তাদের পেছন থেকে গুলি করতে শুরু করল। সেনাদল খোলা জায়গায় চলে এলে চেচেনরা আর ধাওয়া করল না। বাটলারের কোম্পানির একজনও আহত হয়নি। সে সবচেয়ে খুশি আর তেজিভাব নিয়ে ফিরে চলেছে। সকালের ঝরনাটা হেঁটে পার হয়ে সেনাদলটি ভুট্টাখেত আর ঘাসের ভেতর ছড়িয়ে গেল। প্রতিটা কোম্পানির গায়ক দল সামনে এগিয়ে গিয়ে গান ধরল।
বাদ্যের তালে তালে ঘোড়াগুলো চলছে খোশমেজাজে। কোম্পানির লোমশ কুকুর ট্ৰেজোরকা লেজ বাঁকিয়ে সামনে সামনে দৌড়ে চলেছে। একজন কমান্ডারের মতো। যেন কোম্পানির দায়িত্ব তারই। বাটলার উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত, শান্ত। যুদ্ধ তার কাছে শুধু সম্ভাব্য মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়ে পুরস্কার এবং এখানকার সহযোদ্ধাদের ও রাশিয়ার বন্ধুদের শ্রদ্ধা আদায়ের উপায়। নিহত বা আহত অফিসার, সৈন্য বা পাহাড়িরা : যুদ্ধের এই অপর দিকটি তার কল্পনায় কখনো আসেনি। এই কাব্যিক ভাবটি ধরে রাখার জন্য সে অচেতনভাবে নিহত বা আহতদের দিকে তাকানো এড়িয়ে চলে। সেদিন তিনজন নিহত হয়েছিল, আহত হয়েছিল বারোজন। সে চিত হয়ে পড়ে থাকা একটি লাশের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক চোখে নমনীয় হাতটির অদ্ভুত ভঙ্গি আর কপালে একটি লাল বিন্দু দেখে আর দাঁড়ায়নি। পাহাড়িরা তার কাছে শুধু অশ্বারোহী যোদ্ধা, যাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হয়।