বিবিকভকে বিদায় করে তিনি কর্তব্য সুচারুভাবে শেষ করার অনুভূতি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন এবং বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বের হয়ে গেলেন। বিহ্ন লাগানো রাজকীয় পোশাক পরে পদকগুলো লাগালেন এবং গলায় রিবন বেঁধে অভ্যর্থনার হলে গেলেন। সেখানে ছিল এক শ জনের বেশি নারী-পুরুষ; পুরুষদের পরনে সামরিক পোশাক আর নিচু গলার অভিজাত পোশাকে মেয়েরা। তারা নিজেদের জায়গায় অস্থিরভাবে তার আগমনের অপেক্ষা করছিলেন।
নিষ্প্রাণ দৃষ্টি নিয়ে তিনি তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। স্ফীত বুক এবং উদর যেন বন্ধনীর নিচ থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে। তার ওপর সবার ভীত অনুগত দৃষ্টি তিনি অনুভব করছিলেন। তিনি আরও বিজয়দৃপ্তভাৰ গ্ৰহণ করলেন। কাউকে চিনতে পারলে তাদের কাছে দাঁড়িয়ে দু-একটি শব্দ বিনিময় করলেন, কখনো রুশ, কখনো ফরাসি ভাষায়। তার শীতল কাঁচের মতো দৃষ্টিতে বিধে ফেলে তাদের কথাও শুনলেন।
নববর্ষের সব অভিনন্দন গ্রহণ করে তিনি সেগুলো চার্চে পাঠিয়ে দিলেন। ঈশ্বর তার ভত্য যাজকদের মাধ্যমে মাটির মানুষের মতোই নিকোলাসকে স্বাগত জানায় ও প্রশংসা করে। সেসব প্রশস্তি গ্রহণ করে ক্লান্ত হলেও তিনি তা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন। এগুলো সবই ঘটে ঠিক যেভাবে ঘটা উচিত। কারণ, সারা বিশ্বের মঙ্গল ও সুখ তার ওপরই নির্ভর করে। এগুলোতে তিনি ক্লান্ত হলেও বিশ্বকে কখনো সাহায্যবঞ্চিত করেননি।
গির্জার নিম্নমান পাদরি জমকালো পোশাকে সজ্জিত, মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। প্রার্থনা শেষ হলে তিনি ভজন শুরু করলেনচমৎকার গায়ক দল দরদভরা গলায় অনেক বছর ভজনটি ধরল। নিকোলাস চারদিকে তাকিয়ে নেলিদোভাকে দেখতে পেলেন। সুন্দর কাঁধটি নিয়ে জানালার পাশে সে দাঁড়ানো। তিনি তাকে গত রাতের মেয়েটির সঙ্গে তুলনা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
প্রার্থনার পর তিনি সম্রাজ্ঞীর কাছে গেলেন। পরিবারের সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটালেন বাচ্চাদের ও স্ত্রীর সঙ্গে মশকরা করে। তারপর হার্মিটেজের উইন্টার প্যালেসের লাগোয়া জাদুঘর ভেতর দিয়ে রাজদরবারের মন্ত্রী ভনস্কির কার্যালয়ে গেলেন। অন্যান্য কাজের মধ্যে বিশেষ তহবিল থেকে গত রাতের মেয়েটির মাকে বার্ষিক ভাতা দিতে বললেন। সেখান থেকে তার নিয়মিত ভ্রমণে বের হলেন।
রাতের খাবার দেওয়া হয়েছিল পম্পিয়ান হলে। নিকোলাস ও মিখায়েলের ছোট ছেলেদের সঙ্গে আমন্ত্রিত ছিলেন ব্যারন লিভেন, কাউন্ট রেজভস্কি, দোলগোরুকি, প্রুশিয়ার রাজদূত এবং প্রুশিয়ার রাজার এডিসি।
সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর আগমনের জন্য অপেক্ষা করার সময় ব্যারন লিভেন আর প্রুশিয়ার রাজদূতের মধ্যে পোল্যান্ডের খারাপ খবরটি নিয়ে মজার আলাপ হচ্ছিল ফরাসি ভাষায়।
পেপাল্যান্ড আর ককেশাস রাশিয়ার দুই জ্বালা, বললেন লিভেন। দেশ দুটোর জন্য আমাদের এক লাখ করে সৈন্য দরকার।
আপনি কী বললেন, পোল্যান্ড? রাজদূত কপট বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমাদের এই জ্বালা দিয়ে মেটারনিশ বড় চাল চেলেছেন…
এই সময় সম্রাজ্ঞী হাসি ধরে রেখে মাথা কাঁপাতে কাঁপাতে ঢুকলেন, তার পিছু পিছু নিকোলাস।
খাওয়ার সময় নিকোলাস হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণের কথা বললেন। আরও বললেন, গাছ কেটে আর বেশ কিছু ছোট ছোট দুর্গ বসিয়ে তিনি পাহাড়িদের আটকে ফেলার যে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তার ফলে ককেশাসের যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়া উচিত।
সেদিন সকালেই নিকোলাসের নিজেকে মহাকৌশলবিদ ভাবার দুর্বলতা নিয়ে রাজদূতদের মধ্যে আলাপ হয়েছিল। তাদের মধ্যে দ্রুত চোখের ইশারা বিনিময় হলো। সেই রাজদূতই নিকোলাসের কৌশলের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বললেন, নিকোলাসের কৌশল-মেধা আবার প্রমাণিত হলো।
খাওয়ার পর নিকোলাস গেলেন ব্যালে নাচের আসরে। সেখানে শত শত স্বল্পবসনা মেয়ে কুচকাওয়াজ করে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তিনি জার্মান ব্যালে পরিচালককে ডাকিয়ে আনালেন এবং তাকে একটা হিরের আংটি উপহার দেওয়ার আদেশ দিলেন।
পরদিন চেরনিশভ তার প্রতিবেদনগুলো নিয়ে এলে নিকোলাস আবার ভরন্তসভকে দেওয়া আদেশ পাকা করলেন। হাজি মুরাদ আত্মসমর্পণ করেছেন, তাই চেচেনদের ওপর হামলা বাড়াতে হবে এবং তাদের বেষ্টনী আরও চেপে ধরতে হবে।
চেরনিশভ সেই কথাই লিখলেন ভরন্তসভকে। আরেকজন বার্তাবাহী আরও ঘোড়ার গায়ে আঁচড় বাড়িয়ে জোর কদমে তিবলিস ছুটে গেল।
১৬
নিকোলাসের আদেশ মানতে সে মাসেই সঙ্গে সঙ্গে চেচনিয়ায় আক্রমণ করা হয়, সময়টা ১৮৫২ সালের জানুয়ারি।
আক্রমণে পাঠানো সেনাদলে ছিল দুই ব্যাটালিয়ন পদাতিক, দুই কোম্পানি কসাক এবং আটটি কামান। হালকা পদাতিক সৈন্যরা উঁচু-নিচু রাস্তার দুপাশ দিয়ে লম্বা সারিতে কুচকাওয়াজ করে যায়। লম্বা বুট, ভেড়ার চামড়ার কোট এবং মাথায় লম্বা টুপি পরা সৈন্যদের কাঁধে রাইফেল, বেল্টভর্তি কার্তুজ।
বৈরী এলাকার মধ্য দিয়ে যত দূর সম্ভব নিঃশব্দে যাওয়াটাই নিয়ম। শুধু মাঝেমধ্যে খাড়িতে নামার সময় নড়াচড়ায় কামানগুলো ঝংকার তুলছে। অথবা কামানটানা ঘোড়াগুলো নিঃশব্দে চলার আদেশ না বুঝে নাক দিয়ে বা চিহি করে ডাক দিয়ে ফেলেছে। কখনো সারি দুটোর দূরত্ব বেশি হয়ে গেলে কমান্ডার রেগে চাপা হেঁড়ে গলায় সৈন্যদের বকেছে। শুধু একবার নৈঃশব্দ্য ভেঙে গেল! হঠাৎ কাঁটাগাছের ঝোঁপের ভেতর থেকে দৌড়ে সৈন্যদের মধ্যে ঢুকে পড়ল বুকের দিকটা সাদা আর পিঠ কালো একটি ছাগল। ওটার পিছু পিছু দৌড়ে এল একই রকম রঙের একটা পাঁঠা, শিং দুটো পেছনের দিকে বাকানো। বড় বড় ঝাপে সুন্দর প্রাণী দুটো গোলন্দাজ বাহিনীর কাছে চলে এলে সৈন্যরা হইহল্লা করে ওগুলোর পেছনে দৌড়াতে শুরু করে। উদ্দেশ্য, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা। কিন্তু ছাগল দুটো পিছিয়ে সৈন্যদের মধ্য দিয়ে বের হয়ে গেল। কয়েকজন ঘোড়সওয়ার পিছু নিলে তাদের কুকুরগুলো পাখির মতো উড়ে পাহাড়ের দিকে ধাওয়া করে।