ঘটনাটি এ রকম : এক তরুণ পরীক্ষায় দুবার ফেল করলে তৃতীয়বার তার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছিল। পরীক্ষক সেবারও তাকে পাস করায়নি। তরুণটি সেটাকে অন্যায় মনে করে আর ধৈর্য রাখতে পারেনি। ক্ষিপ্ত হয়ে সে একটা কাগজকাটা ছুরি নিয়ে শিক্ষককে তাড়া করে তার গায়ে কয়েকটা আঁচড় দেয়।
তার নাম কী? নিকোলাস জিজ্ঞেস করলেন।
বেজভস্কি।
পোলিশ?
পোলিশ বংশোদ্ভূত, রোমান ক্যাথলিক, চেরনিশভ জবাব দিল।
নিকোলাস ভুরু কোঁচকালেন। তিনি পোলিশদের যথেষ্ট সর্বনাশ করেছেন। সেই সর্বনাশকে বৈধতা দিতে তাকে নিশ্চিত হতে হয় যে সব পোলিশই বদমাশ, তিনি তা-ই মনে করেন এবং তিনি যে সর্বনাশ করেছেন, সেই পরিমাণে তাদের ঘৃণা করেন।
একটু থামুন, চোখ মুদে মাথা নিচু করে তিনি বললেন।
চেরনিশভ নিকোলাসকে এ কথা বহুবার বলতে শুনেছেন। তাই জানেন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সম্রাটকে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করতে হয়। তিনি চিন্তায় মগ্ন হন, সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত তখন আপনাআপনি চলে আসে, যেন অন্তর থেকে কেউ তাকে তা করতে বলেছে। তিনি ভাবছিলেন, এই ঘটনা তার ভেতরে পোলিশদের প্রতি যেটুকু ঘৃণা জাগিয়েছে, কী করলে তা তুষ্ট হবে। ভেতরের কেউ তাকে নিচের সিদ্ধান্তটি দিল। তিনি প্রতিবেদনটির পাশে তার বড় বড় অক্ষরে তিনটি ভুল বানানে লিখলেন :
মিত্রুর যোজ্ঞ, কিন্তু খোদার রহম, আমাদের মিত্রুদন্ড নেই এবং আমি তা শুরু করতে যাচ্ছি না। তাকে বারোবার এক হাজার লোকের মধ্যে দস্তানাদৌড় দেওয়া হোক। নিকোলাস। [ভুল বানানের শব্দগুলো ভুল বানানে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো মৃত্যু, যোগ্য আর মৃত্যুদন্ড। দস্তানার মার শাস্তিতে অপরাধীকে দুই সারি সৈন্যের মধ্য দিয়ে দৌড়াতে হয় আর সৈন্যরা তাকে আঘাত করতে থাকে।
তিনি তার অস্বাভাবিক বড় প্যাচানো স্বাক্ষর দিলেন। নিকোলাস জানতেন, বারো হাজার আঘাত শুধু নির্যাতনে নিশ্চিত মৃত্য নয়, প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতাও। সবচেয়ে শক্তিশালী একটি লোককে মেরে ফেলতে পাঁচ হাজার আঘাতই যথেষ্ট। কিন্তু নির্দয়-নিষ্ঠুর হয়ে তিনি আনন্দ পান আবার রাশিয়ায় মৃত্যুদণ্ড না থাকার আনন্দও পাচ্ছেন।
ছাত্রটির ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্ত লিখে তিনি কাগজটি চেরনিশভের দিকে ঠেলে দিলেন।
এই যে, পড়ুন। তিনি বললেন।
চেরনিশভ পড়লেন এবং সিদ্ধান্তের প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে শ্রদ্ধাভরে মাথা নত করলেন।
হ্যাঁ, শাস্তি দেওয়ার সময় কুচকাওয়াজের মাঠে সব ছাত্রকে হাজির থাকতে হবে। নিকোলাস বললেন।
এটা তাদের জন্য ভালো হবে। আমি সব বিপ্লবী চেতনাকে নির্মূল করে ফেলব! তিনি ভাবলেন।
তা-ই করা হবে, চেরনিশভের জবাব; একটু থেমে কপালের চুলের গোছাটি ঠিক করে ককেশাসের প্রতিবেদনটি তুললেন।
প্রিন্স ভরন্তসভের চিঠির কী জবাব দিতে হুকুম করেন?
চেচনিয়ায় বাড়িঘর আর খাদ্য পৌঁছানোর পথ বন্ধ করার আদেশ কঠোরভাবে পালন করতে হবে আর হামলা করে তাদের ব্যতিব্যস্ত করতে হবে, নিকোলাস বললেন।
আর হাজি মুরাদকে নিয়ে কী করতে আদেশ দিচ্ছেন?
কেন? ভরন্তসভ তো লিখেছে, তাকে ককেশাসে ব্যবহার করতে চায়।
এটা কি বিপজ্জনক নয়? চেরনিশভ বললেন। নিকোলাসের দৃষ্টি এড়িয়ে বললেন, আমার মনে হয় প্রিন্স ভরন্তসভ মানুষকে বেশি বিশ্বাস করেন।
তাই, আপনি কী মনে করেন? ভরসভের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিতে চেরনিশভের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে নিকোলাস তীক্ষ্ণভাবে প্রশ্ন করলেন।
আমি ভাবছিলাম, তাকে মধ্য রাশিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়াই নিরাপদ।
আপনি ভাবছিলেন! বিদ্রুপের সুরে বললেন নিকোলাস। কিন্তু আমি তা ভাবছি না। আমি ভরসভের সঙ্গে একমত। তাকে সেভাবেই জবাব দিন।
তা-ই দেব, বলে উঠে মাথা নুয়ে বিদায় নিলেন চেরনিশভ।
দোলগোরুকিও মাথা নুয়ে বিদায় নিল, সারা সময়ে শুধু (নিকোলাসের প্রশ্নের জবাবে) সৈন্য পাঠানোর ব্যাপারে দু-একটি শব্দ উচ্চারণ করে।
চেরনিশভের পর নিকোলাস পাশ্চাত্যের প্রদেশগুলোর জেনারেল-গভর্নর বিবিকভকে দর্শন দিলেন। অর্থোডক্স ধর্মমত মানতে নারাজ বিদ্রোহী কৃষকদের বিরুদ্ধে বিবিকভ যে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা অনুমোদন করলেন। যারা আত্মসমর্পণ করেনি, তাদের সবাইকে সামরিক আদালতে বিচারের আদেশ দিলেন। সেটাও দস্তানাদৌড়ের সমান। তারপর তিনি একটি সংবাদপত্রের সম্পাদককে সৈনিক হিসেবে খাটতে পাঠানোর আদেশ দিলেন। সম্পাদকের অপরাধ, সে কয়েক হাজার রাষ্ট্রীয় চাষিকে সম্রাটের খামারে বদলির খবর ছেপেছিল।
আমি এটা প্রয়োজন মনে করেই করছি, বললেন নিকোলাস। আমি এটা নিয়ে আলোচনা করতে দেব না।
বিবিকভ ইউনিয়েট ইউনিয়েটরা রোমের পোপকে স্বীকার করে। অন্যান্য বিষয়ে রুশো-গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের সঙ্গে তাদের বিরোধ নেই) চাষিদের ব্যাপারে দেওয়া আদেশটির নিষ্ঠুরতা বুঝতে পারলেন। বুঝতে পারলেন (তখনকার দিনে একমাত্র স্বাধীন চাষি) রাষ্ট্রীয় চাষিদের রাজার অধীনে নিয়ে আসার অন্যায়টাও। এর ফলে ওই চাষিরা রাজপরিবারের দাসে পরিণত হবে। কিন্তু ভিন্নমত প্রকাশ করা অসম্ভব ছিল। নিকোলাসের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হওয়ার অর্থ ছিল এখনকার চমৎকার পদমর্যাদাটি হারানো। এটা পেতে বিবিকভের চল্লিশ বছর লেগেছে এবং বেশ লাগছে এবং তাই সে অনুগতভাবে রুপালি ছোপ ধরা কালো মাথাটি নুয়ে তার সম্মতি এবং সম্রাটের নিষ্ঠুর, বিবেকহীন অসৎ ইচ্ছা কার্যকর করতে তার প্রস্তুতি জানাল।