হ্যাঁ, আমাকে ছাড়া রাশিয়া চলবে কী করে? তিনি বললেন, আগের অসন্তোষের অনুভূতিটা ফিরে আসছিল। হ্যাঁ, শুধু রাশিয়া কেন, আমি না থাকলে পুরো ইউরোপের কী হবে? তার ভগ্নিপতি প্রুশিয়ার রাজার দুর্বলতা ও বোকামির কথা ভেবে তিনি মাথা নাড়লেন।
ছোট গাড়িবারান্দাটার দিকে ফিরে আসার পথে তিনি দেখতে পেলেন, হেলেনা পাভলোভনার গাড়িটা প্রাসাদের সাল্টিকভ ফটক দিয়ে ঢুকছে। সঙ্গে একজন লাল উর্দিপরা ভৃত্য।
তার কাছে হেলেনা পাভলোভনা অকর্মা লোকদের প্রতিভূ। এরা শুধু বিজ্ঞান ও কবিতা নিয়েই নয়, মানুষকে কীভাবে শাসন করতে হবে, সেটা নিয়েও আলোচনা করে। যেন নিকোলাস যেভাবে শাসন করছে, তারা তার চেয়ে ভালো শাসন করতে পারবে। তিনি জানতেন, এ ধরনের লোকদের তিনি যতই দমিয়ে রাখেন না কেন, তারা বারবার সে কাজ করতে থাকে। তার ভাই মাইকেল পাভলোভিচের কথা মনে হলো নিকোলাসের। মারা গেছে খুব বেশি দিন হয়নি। বিরক্তি ও ব্যথায় তার মনটা ভরে গেল। ভুরু দুটো গভীরভাবে কুঁচকে তিনি ফিসফিস করে আবার মাথায় যা আসে, সেই শব্দগুলো আওড়াতে থাকলেন। প্রাসাদে ঢাকা পর্যন্ত তিনি তা করতে থাকলেন।
নিজের ঘরে ঢুকে তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গোঁফের মাথা দুটো চোখা করে ঠেলে দিলেন ওপরের দিকে। কপালের দুপাশের চুলের গোছা আর টাকঢাকা পরচুলাটা ঠিক করলেন। তারপর সোজা চলে গেলেন প্রতিবেদন গ্রহণের ঘরটায়।
তিনি প্রথমেই ডাকলেন চেরনিশভকে। ঘরে ঢুকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নিকোলাসের মেজাজ আজ খুব খারাপ। গত রাতের ঘটনা জানতেন বলে কারণটা বুঝতে পেরেছিলেন। শীতল অভ্যর্থনা জানিয়ে চেরনিশভকে বসতে বলে নিকোলাস তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। চেরনিশভ প্রথমে তুললেন রসদ বিভাগের কর্মকর্তাদের তহবিল তছরুপের সর্বশেষ ঘটনা; পরেরটা ছিল প্রুশিয়ায় সেনা মোতায়েনের বিষয়। তার পরেরটা নববর্ষের পুরস্কারের তালিকায় বাদ পড়া লোকদের নাম। তারপর তুললেন হাজি মুরাদের বিষয়ে ভরসভের প্রতিবেদন। সবশেষে একাডেমি অব মেডিসিনের একজন শিক্ষককে এক ছাত্রের হত্যাচেষ্টার কিছু খুঁটিনাটি অপ্রিয় প্রসঙ্গ।
নিকোলাস নিঃশব্দে ঠোঁট দুটো চেপে রেখে তহবিল তছরুপের ঘটনা শুনছিলেন আর বিশাল সাদা হাতের আংটি পরা আঙুলটি দিয়ে কাগজের ওপর টোকা দিচ্ছিলেন। চোখ দুটো আটকে ছিল চেরনিশভের কপাল ও তার ওপরে চুলের গোছাটার দিকে।
নিকোলাস বিশ্বাস করতেন, সবাই চুরি করে। তিনি জানতেন, রসদ বিভাগের কর্মকর্তাদের শাস্তি দিতে হবে। তাই সবাইকে পদাবনতির আদেশ দিলেন। তিনি জানতেন, তাদের জায়গায় যারা উঠে এল, তারাও সে কাজটিতে বিরত থাকবে না। চুরি করা ছিল কর্মকর্তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তার কাজ তাদের শাস্তি দেওয়া। এ কাজে ক্লান্ত হয়ে গেলেও তিনি ভালোভাবেই তা করছিলেন।
মনে হচ্ছে রাশিয়ায় মাত্র একজন লোক সৎ! তিনি বললেন।
চেরনিশভ সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছিলেন সে লোকটি নিকোলাস নিজে, তাই সম্মতি দিতে মৃদু হাসলেন।
তাই মনে হয়, মহামহিম।
এগুলো রেখে দিন, আমি পরে দেখব, বলে টেবিলের বাঁ দিকে কাগজগুলো রাখলেন।
তারপর চেরনিশভ পুরস্কার দেওয়ার আর প্রুশিয়ায় সীমান্তে সৈন্য পাঠানোর বিষয়টি তুললেন।
নিকোলাস তালিকাটির ওপর চোখ বুলিয়ে কয়েকটি নাম কেটে দিলেন। আর সংক্ষেপে প্রুশিয়ার সীমান্তে দুই ডিভিশন সৈন্য পাঠানোর আদেশ দিলেন। ১৮৪৮ সালের ঘটনার পর দেশের মানুষকে সংবিধান দেওয়ার জন্য নিকোলাস প্রুশিয়ার রাজাকে ক্ষমা করতে পারেননি। চিঠি ও আলোচনায় আত্মীয়ের সঙ্গে (শ্যালক) সহৃদয়ভাব দেখালেও সীমান্তে সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদি দরকার হয়। প্রুশিয়ার মানুষ বিদ্রোহ করলে তার আত্মীয়ের সিংহাসন রক্ষায় সে সৈন্যদের তিনি কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। (নিকোলাস সবখানেই বিদ্রোহের আশঙ্কা দেখতেন। কয়েক বছর আগে যেমন হাঙ্গেরির বিদ্রোহ দমাতে তিনি সৈন্যদের লাগিয়েছিলেন। প্রুশিয়ার রাজাকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তার গুরুত্ব বাড়ানোও সৈন্য পাঠানোর আরেক কারণ।
হ্যাঁ, আমি না থাকলে রাশিয়া এখন কী করত, আবার তিনি ভাবলেন।
বেশ, আর কী আছে?
ককেশাস থেকে পাঠানো একটি বার্তা, বলে চেরনিশভ হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণ সম্বন্ধে ভরন্তসভ যা লিখেছিলেন, তা জানালেন।
হায় খোদা! বললেন নিকোলাস। যাক, শুরুটা ভালোই হয়েছে!
মহামহিম যা পরিকল্পনা করেছিলেন, তা কাজে দিচ্ছে বলেই প্রমাণিত হলো, চেরনিশভ বলল।
তার কৌশল ঠিক করার প্রতিভার স্বীকৃতি নিকোলাসের জন্য সুমধুর ছিল। তিনি এই প্রতিভা নিয়ে গর্ব করতেন। কিন্তু মনের গহনে তিনি জানতেন, ওই রকম কোনো পরিকল্পনার অস্তিত্ব নেই এবং এখন তিনি তার প্রতিভার প্রশস্তি আরও শুনতে চাচ্ছেন।
কী বলতে চাচ্ছেন? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
আমি মনে করছি, মহামহিম, আপনার পরিকল্পনা যদি অনেক আগে থেকে কাজে লাগিয়ে আমরা ধীরস্থিরভাবে বন-জঙ্গল কেটে ফেলতাম আর খাবার পৌঁছানোর পথ বন্ধ করে দিতাম, তাহলে ককেশাস অনেক আগেই। বশ্যতা স্বীকার করত। হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণ থেকে আমি মনে করছি, তারা আর টিকতে পারছে না।
ঠিক, বললেন নিকোলাস।
অবশ্য বন কেটে আর খাবার পৌঁছানোর পথ বন্ধ করে শত্রুর এলাকায় ধীরে ধীরে এগোনোর পরিকল্পনাটি ছিল এরমোনভ আর ভেলিয়ামিনভের। নিকোলাসের পরিকল্পনার ঠিক উল্টো। নিকোলাসের পরিকল্পনা ছিল শামিলের বাড়ি দখল করে ডাকাতদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়ার। যে পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮৪৫ সালে দারগো অভিযান চালানো হয়। সে অভিযানে অনেক প্রাণহানি হয়েছিল। তা সত্ত্বেও নিকোলাস পরিকল্পিতভাবে জঙ্গল কেটে এলাকাটা ধ্বংস করে দেওয়ার প্রস্তাব তার নিজের বলে মেনে নিলেন। এতে মনে হতে পারে, বনের গাছ কেটে আর খাবার পৌঁছানোর পথ বন্ধ করে দিয়ে ধীরে ধীরে এগোনোর প্রস্তাব তার নিজের বলে জাহির করার; কারণ, তিনি ১৮৪৫ সালে অভিযানের ঠিক উল্টো যে পরিকল্পনা করেছিলেন, সেটা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তা নয়। অভিযানের পরিকল্পনার জন্য তিনি গর্ব করেন, ধীরে এগোনোর পরিকল্পনা নিয়েও গর্ব করেন। যদিও একটা আরেকটার ঠিক উল্টো বলে প্রমাণিত হয়ে গেছে। চারপাশের সবার কাছ থেকে সারাক্ষণ সত্যের বদলে নির্লজ্জ তোষামোদি শুনে শুনে তার অবস্থা এমন হয়েছে যে তিনি আর নিজের অসংগতিগুলো দেখতে পান না। বাস্তবতা, যুক্তি বা আক্কেল-বুদ্ধিতে তিনি কী করছেন, বিচার করে দেখেন না। তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেন, তার আদেশগুলো যুক্তিযুক্ত এবং ন্যায়সংগত হতে বাধ্য। কারণ, তিনি সেগুলো দিয়েছেন, সেগুলো যতই কাণ্ডজ্ঞানহীন, অন্যায্য বা পরস্পরবিরোধী হোক না কেন। পরের ঘটনাটিতে তার আদেশ তেমনি কাণ্ডজ্ঞানহীন ধরনের ছিল। সেটা ছিল একাডেমি অব মেডিসিনের ছাত্রের ঘটনা।