নিকোলাস বসেছিলেন কালো কোট পরে। কাঁধের ফিতেগুলো আছে কিন্তু বিহ্নগুলো নেই ওতে। তার বিশাল বপুটি চেয়ারের পেছনে হেলানো। অতিকায় ফুলে ওঠা পেটটা কারুকাজ করা ফিতে দিয়ে শক্ত করা বাধা। দৃষ্টি আগতদের দিকে স্থির নিবদ্ধ–চোখ প্রাণহীন। সামনের দিকে আঁচড়ানো টিকে থাকা চুলের গোছা এবং টাকটাকা পরচুলার মাঝের জায়গাটুকুতে কপাল ক্রমেই পিছিয়ে চলেছে। তার লম্বা, ফ্যাকাশে চেহারা সেদিন বিশেষ শীতল ও নিষ্প্রাণ। তার চিরনিষ্প্রভ চোখ আরও অনুজ্জ্বল! ওপরের দিকে ঘোরানো গোঁফের নিচে ঠোঁট দুটো চাপা। সসেজ আকারের দুটো গোঁফের ডগা রাখা হয়েছে সদ্য কামানো মোটা গালের ওপর। উঁচু কলার সে দুটোকে ঠেকা দিয়ে রেখেছে। মুখের ওপর ঠাসা চিবুকটিও চেহারায় অসন্তোষ ও বিরক্তির ছাপটিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তার বিরক্তির কারণ তিনি ক্লান্ত। ক্লান্তির কারণ আগের রাতে তিনি অভ্যাসমতো অশ্বারোহী সৈন্যের ছদ্মবেশে মুখোশ পরার আসরে (মাসকারেন্ড) গিয়েছিলেন। সবাই তার বিশাল দেহটির জন্য জায়গা করে দিচ্ছিল। আগের আসরে একটি মুখোশ তার গায়ের রং, চমৎকার শরীর আর মধুর কণ্ঠে তার (নি) জরাগ্রস্ত যৌন ক্ষুধাকে জাগিয়ে তুলেছিল। পরের আসরেও আসবে কথা দিয়ে সেবার সে চলে যায়।
গত রাতে সেই মুখোশ তার কাছে এসেছিল। তিনি তাকে আর যেতে দেননি। একা সময় কাটানোর জন্য সাজানো কুঠরির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। চুপিসারে সেখানে গিয়ে সেখানকার পরিচারককে পেলেন না। নিকোলাস নিজ হাতে দরজা খুলে মহিলাকে আগে ঢুকতে দিলেন।
এখানে বোধ হয় কেউ আছে! ঢুকতেই থেমে গিয়ে মুখোশ-মহিলা ফরাসিতে বললেন।
কুঠরিতে আসলেই লোক ছিল। মখমলে মোড়া ছোট সোফাটায় ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে ছিল বর্শাধারী বাহিনীর একজন অফিসার এবং ঘোমটাওয়ালা আলখাল্লা পরা কোঁকড়া চুলের এক সুন্দরী। মেয়েটি মুখোশ খুলে রেখেছিল, ক্রুদ্ধ নিকোলাসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই সে মুখোশ দিয়ে তাড়াতাড়ি মুখটা ঢেকে ফেলল। ভয়ে পাথর হয়ে অফিসারটি সোফা থেকে উঠতেই পারল না। শুধু কাতর চোখে তাকিয়ে থাকল নিকোলাসের দিকে।
লোকের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করায় অভ্যস্ত নিকোলাস সেটা উপভোগ করতেন এবং কোনো কোনো সময় ভয়ে চুপসে যাওয়া লোকদের দয়া দেখিয়ে তিনি তাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে মজা পেতেন। এবারে তিনি তা-ই করলেন।
ভীতবিহ্বল অফিসারটিকে বললেন, বেশ বন্ধু! তুমি আমার চেয়ে ছোট, তাই তোমার জায়গাটা আমাকে ছেড়ে দিতে পারো।
তড়াক করে উঠে দাঁড়াল অফিসারটি। প্রথমে ফ্যাকাশে, তারপর লাল হয়ে প্রায় দ্বিগুণ কুঁজো হয়ে নীরবে সঙ্গিনীর অনুসরণ করল। নিকোলাস মহিলাকে নিয়ে একা হলেন।
বোঝা গেল, সুন্দরী সঙ্গিনী একজন সুইডিশ গৃহশিক্ষিকার বছর বিশেকের কুমারী মেয়ে। সে বলল কেমন করে বাচ্চা থাকতেই নিকোলাসের ছবি দেখে তার প্রেমে পড়ে। কত গভীরভাবে তাকে চেয়েছে এবং যেকোনো উপায়ে তার চোখে পড়বে বলে ঠিক করে। এখন সে সফল, তার আর কিছুই চাই না।
নিকোলাস যেখানে মেয়েদের সঙ্গে মেশেন, মেয়েটিকে প্রাসাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে নিকোলাস তার সঙ্গে এক ঘণ্টার বেশি সময় কাটালেন।
সে রাতে ঘরে ফিরে নিকোলাস তার শক্ত সরু বিছানায় শুয়ে পড়লেন। বিছানাটি নিয়ে তার অনেক গর্ব এবং গায়ে যে চাদরটি টেনে নিলেন, তিনি মনে করতেন এবং বলতেন), সেটা নেপোলিয়নের টুপির চেয়ে বিখ্যাত। ঘুমিয়ে পরতে তার অনেক সময় লাগল। তার চোখে একবার ভাসছিল মেয়েটির সুন্দর মুখে শঙ্কামেশানো আনন্দের অভিব্যক্তি, আবার তার নিয়মিত রক্ষিতা নেলিদোভার চওড়া কাঁধ। তিনি দুটোর তুলনা করছিলেন। বিবাহিত পুরুষদের লাম্পট্য খারাপ জিনিস, কথাটি একবারও তার মাথায় আসেনি। কেউ এ জন্য অনুযোগ করলে তিনি খুবই বিস্মিত হতেন। তিনি যথার্থ কাজ করেছেন, এ বিষয়ে সন্তুষ্ট হলেও কিন্তু অস্বস্তি একটা রয়েই গেল। এই অনুভূতিটার গলা টিপে মারতে যে জিনিসটা তাকে শান্ত করে, তিনি তা-ই করলেন–নিজ মহিমার কথা ভাবলেন।
অনেক দেরি করে ঘুমালেও তিনি আটটার আগেই উঠে পড়েছিলেন। প্রক্ষালনের কাজ সেরে অভ্যাসমতো তার বিশাল শরীরে বরফ ঘষলেন। প্রার্থনা করলেন (ছোটবেলা থেকে না বুঝে যে প্রার্থনা করে আসছেন তা-ই, প্রথমে যিশুমাতা, পরে যিশু ও সবশেষে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা)। তারপর তার সামরিক চাদর এবং টুপি পরে প্রাসাদের ছোট গাড়িবারান্দাটি দিয়ে বের হয়ে চলে গেলেন বাঁধের কাছে।
বাধে আইনশাস্ত্রের কলেজের পোশাক পরা তার মতোই হোঁতকা এক ছাত্রের দেখা পেলেন। পোশাকটি চিনতে পেরে ভুরু কুঁচকালেন তিনি। মুক্তচিন্তা করে বলে কলেজটি তার অপছন্দ। কিন্তু ছেলেটির স্বাস্থ্য এবং যত কষ্টে ছেলেটি নিজেকে সোজা রেখে দর্পভরে তাকে স্যালুট ঠকল, তাতে নিকোলাস নরম হলেন।
তোমার নাম কী?
পোলসাতভ, মহামহিম।
বেশ!
ছেলেটি তার হাত টুপি পর্যন্ত তুলে রেখে দাঁড়িয়ে থাকল।
নিকোলাস থামলেন।
তুমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাও?
মোটেই না, মহামহিম।
বোকা! নিকোলাস ঘুরে নিজের পথে চলতে শুরু করলেন। যে কথাগুলো তার মাথায় আসছিল, তা-ই উচ্চারণ করছিলেন।
কোপারভাইন…কোপারভাইন, বললেন বেশ কয়েকবার, গত রাতের মেয়েটির নাম। জঘন্য…জঘন্য, যা বলছিলেন ভেবে বলেননি। কিন্তু তা শুনে তার অনুভূতি স্তব্ধ হয়ে গেল।