ককেশাস সম্বন্ধে আগের প্রতিবেদনটা দেওয়ার সময় তিনি ভরসভের বিরুদ্ধে সম্রাটের অসন্তোষ জাগাতে সফল হয়েছিলেন। কারণ, সেনাপতিদের বেখেয়ালের জন্য ছোট একটা ককেশীয় সৈন্যদলকে পাহাড়িরা খতম করে দেয়। চেরনিশভ এখন হাজি মুরাদের ব্যাপারে ভরন্তসভ যা করেছে, সেগুলো দিয়ে কান ভারী করতে চাইছেন। তিনি সম্রাটকে বলতে যাচ্ছেন যে ভরসভ সব সময় রুশদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের রক্ষা করে আর সুবিধা দেয়। এবার সে হাজি মুরাদকে ককেশাসে থাকতে দিয়ে অবিজ্ঞের মতো কাজ করেছে। কারণ, সে আমাদের প্রতিরক্ষার বিষয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছে বলে সন্দেহ করা যায়। তাই ভালো হবে তাকে মধ্য রাশিয়ায় পাঠিয়ে দিলে। তার পরিবারকে পাহাড়িদের কাছ থেকে উদ্ধার করে তার বিশ্বস্ততার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে কাজে লাগানো যাবে।
চেরনিশভের পরিকল্পনা সফল হলো না। একমাত্র কারণ, নববর্ষের দিনে সম্রাট নিকোলাসের মেজাজ বিশেষ খারাপ ছিল। ওই বিকারের সময় কোনো রকম পরামর্শ গ্রহণ করার কথা নয়। চেরনিশভের পরামর্শ তো একদমই না। তাকে বাদ দিতে পারছেন না বলেই এখন তাকে সহ্য করছেন নিকোলাস। তাকে তিনি নীতিহীন লোক মনে করেন। নিকোলাসের সিংহাসনে আরোহণের সময় সংবিধানের জন্য ডিসেম্বর ষড়যন্ত্রীদের বিচারকালে চেরনিশভ যাচারি চেরনিশভের শাস্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন আর তার সম্পত্তি দখলের চেষ্টা চালান। তাই নিকোলাসের বদমেজাজকে সাধুবাদ, হাজি মুরাদ ককেশাসেই রয়ে গেলেন। তার অবস্থাও বদলাল না, চেরনিশভ অন্য কোনো সময় প্রস্তাবটি তুললে যা হতে পারত।
.
তাপমাপকে মাত্রা শূন্যের নিচে, ১৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সাড়ে নয়টায় চেরনিশভের দাড়িওয়ালা গাড়োয়ান শীতসকালে কুয়াশার মধ্য দিয়ে ছোট স্লেজটাকে চালিয়ে আনল। ওটা নিকোলাসের স্লেজটার মতোই। ছোট একটা বাক্সে সে বসে ছিল মোটা শরীর নিয়ে। মাথার ওপরে চোখা কুশন আকারের উজ্জ্বল নীল মখমলের টুপি। উইন্টার প্যালেসের ফটক দিয়ে গাড়িটি ঢুকিয়ে তার দোস্ত প্রিন্স দলগরুকির গাড়োয়ানকে ঘাড় নেড়ে শুভেচ্ছা জানায়। সে-ও তার কর্তাকে নিয়ে প্রাসাদে এসেছে। পুরু কাপড় লাগিয়ে প্রায় পিণ্ড বানানো বিশাল কোটের মধ্যে সে বাইরে বসে আছে অনেকক্ষণ। গাড়োয়ানের আসনে বসে জমে যাওয়া হাতগুলো ঘষে ঘষে গরম করছে। চেরনিশভ পরেছিলেন বড় একটা চাদর-রুপালি বিভারের (উদবিড়ালের মতো দেখতে চ্যাপ্টা লেজের লোমশ প্রাণী) পশমি গলাবন্ধ, মাথায় আইনমাফিক মোরগের পালক লাগানো তিন কোনা টুপি। স্লেজে ভালুকের চামড়ার পর্দাটি ওপরের দিকে উঠিয়ে তিনি সাবধানে ঠান্ডা পাগুলো বের করে আনলেন। জুতার ওপরে কোনো গলোশ (জুতাসহ পরার রাবারের পানিরোধক) পরেননি তিনি। কখনোই এই বুটগুলো পরেন না বলে তার অহংকার। তাকে সম্মান দেখিয়ে দারোয়ান দরজা খুলে ধরেছিল। জুতার নালে ঠংঠং আওয়াজ করে তিনি ঢুকলেন। ভারী চাদরটা খুলতেই একজন খানসামা তা নিয়ে নিল। চেরনিশভ আয়নার কাছে গিয়ে কোঁকড়া পরচুলার ওপর থেকে সাবধানে টুপিটা খুললেন। আয়নায় নিজেকে দেখে কপাল ও দুপাশ থেকে চুলের গোছাগুলো সরালেন পাকা হাতে। ঠিক করে নিলেন ক্রস, কাঁধে ঝোলানো সোনালি দরা (শোল্ডার-নট) এবং পদমর্যাদার বিহ্নগুলো। তারপর বয়স্ক নড়বড়ে পায়ের ওপর ভর করে গালিচামোড়া ছোট ছোট সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। দর্শনার্থীদের ঘরের আজ্ঞাবহ খানসামা মাথা নুয়ে অভিবাদন জানাল। চেরনিশভ তাকে পার হয়ে ঢুকলেন ঘরের ভেতর। সম্রাটের এডিসি নতুন। মুখে তার তাজা গোলাপি আভা, চিকন গোঁফ আর জুলফিগুলো চোখের দিকে নামানো। নিকোলাসের কায়দায়। ঝকঝকে নতুন বিহ্ন, দরা ও পোশাক পরা এডিসি তাকে সসম্মানে বরণ করল।
প্রিন্স ভাসিলি দলগোরুকি সহকারী সমরমন্ত্রী। তার নীরস চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। চুঁচালো গোঁফ আর নিকোলাসের কায়দায় তার জুলফিও চোখের দিকে টানা। প্রিন্স ভাসিলি তাকে স্বাগত জানালেন।
সম্রাট কি আছেন! মন্ত্রিসভার দরজার দিকে অনুসন্ধানী চোখে তাকিয়ে চেরনিশভ এডিসিকে জিজ্ঞেস করলেন।
মহামহিম কেবলই ফিরে এসেছেন, এডিসি জবাব দিল। তার চলাফেরা এত কোমল যে মাথার ওপর এক গ্লাস পানি রেখে দিলে তার এক ফোঁটাও যেন ছলকে পড়বে না। শরীরের ভঙ্গি গভীর ভক্তি দেখানোর মতো করে সে এগোল নিঃশব্দ দরজার দিকে।
দলগোরুকি ইতিমধ্যে তার ব্যাগ খুলে দেখে নিয়েছে, দরকারি সব কাগজ আনা হয়েছে কি না। আর চেরনিশভ জমে যাওয়া পায়ে রক্তসঞ্চালন ফিরিয়ে আনতে পায়চারি করছেন আর আউড়ে নিচ্ছেন সম্রাটকে কী বলবেন। তিনি যখন মন্ত্রিসভার দরজার কাছে, ঠিক তখন সেটা আবার খুলে গেল। এডিসি আগের চেয়েও বেশি ভক্তিভরে বের হয়ে মন্ত্রী এবং তার সহকারীকে ভেতরে ঢোকার ইশারা করল।
বিগত শতকে এক ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর উইন্টার প্যালেস আবার বানানো হয়েছিল। কিন্তু নিকোলাস ওপরতলার ঘরগুলোই ব্যবহার করতেন। চমৎকারভাবে সাজানো মন্ত্রিসভার একটি ঘরে তিনি মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থদের প্রতিবেদন গ্রহণ করতেন। ঘরটিতে চারটি বড় বড় জানালা। সামনের দেয়ালে সম্রাট প্রথম আলেকজান্ডারের একটা বিরাট আবক্ষ তেলচিত্র। জানালাগুলোর মাঝখানে দেরাজওয়ালা দুটো দাপ্তরিক টেবিল। দেয়ালের পাশে কয়েকটি চেয়ার। ঘরের মাঝখানে বিশাল একটা লেখার টেবিল। তার সামনে নিকোলাসের জন্য একটা আরামকেদারা আর অন্য চেয়ারগুলো আগতদের জন্য, যাদের কথা শোনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।