জমিটায় জীবিত কোনো কিছুর খোঁজে চারদিকে দেখতে দেখতে আমি ভাবছি। আমার সামনে, রাস্তার ডান দিকে একটা ঝোঁপ দেখতে পেলাম, কাছে গিয়ে দেখি আমি যে জাতের কাটা গেন্ধালি ছেঁড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি, সেগুলোই। এই তাতার গাছটিতে তিনটি উঁটা। তার একটা কাটা হাতের মতো মুড়ে পড়ে আছে। বাকি দুটোয় একটা করে ফুল, আগে লাল ছিল কিন্তু এখন কালো হয়ে গেছে। একটা মাঝবরাবর ভেঙে ঝুলে আছে, সেটার ফুলে মাটি লেপ্টে গেছে। অন্য ডালটা কালো মাটিতে লেপে গেলেও খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। বোঝাই যায় কোনো এক্কা গাড়ির চাকা গাছটাকে মাড়িয়ে গেছে, কিন্তু তারপর ওটা আবার দাঁড়িয়েছে। তাই সোজা হয়ে উঠলেও একদিকে মোচড়ানো, যেন এর গা থেকে এক খাবলা মাংস ছিঁড়ে নেওয়ায় এর ভুড়ি বের হয়ে গেছে আর এর একটা চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে; তারপরও এটা অটলভাবে দাঁড়িয়ে এবং হার মানেনি মানুষের কাছে, যারা গাছটির চারপাশের অন্য সব ভাইকে শেষ করে দিয়েছে…
কী তেজ! আমি ভাবলাম। মানুষ সবকিছু জয় করেছে এবং হাজার হাজার গাছ ধ্বংস করেছে, তারপরও এটা বশ্যতা স্বীকার করবে না। আমার মনে পড়ল বেশ কয়েক বছর আগের একটি ককেশীয় কাহিনি, যার কিছুটা আমি নিজে দেখেছি, কিছুটা চাক্ষুষদর্শীদের কাছে শুনেছি এবং বাকিটা আমার কল্পনা।
সে কাহিনি আমার স্মৃতি ও কল্পনায় যেভাবে এসেছে, তা-ই নিচে দেওয়া ঘটনাটা ঘটেছিল ১৮৫১ সালের শেষ দিকে।
নভেম্বরের শীতে এক সন্ধ্যায় হাজি মুরাদ খুঁটে পোড়ার গন্ধে ভরা বৈরী চেচেন গ্রাম মাখকেতের ভেতর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। গ্রামটি রাশিয়ার সীমা থেকে মাইল পনেরো দূরে। মুয়াজ্জিনের আজান কেবল শেষ হয়েছে। (মৌচাকের কোষগুলোর মতো সাজানো) মাটির ঘরগুলোয় ফিরে আসা গরুর অনুচ্চ হাম্বা এবং ভেড়ার ভ্যা ভ্যা আওয়াজ। সে শব্দ ছাপিয়ে খুঁটের ধোঁয়ায় মিশেল খাওয়া পরিষ্কার পাহাড়ি বাতাসে ভেসে আসা পুরুষদের চাপা গলায় তর্ক এবং কাছে নিচের ঝরনা থেকে মহিলা ও শিশুদের কথাবার্তা তিনি পরিষ্কার শুনতে পেলেন।
হাজি মুরাদ ছিলেন শামিলের নায়েব, নিজের কীর্তিকলাপের জন্য বিখ্যাত। কখনো নিজের ঝান্ডা ছাড়া ঘোড়ায় চড়েননি। সব সময় তার সঙ্গে কয়েক ডজন মুরিদ থাকত, যারা তার আগে আগে ঘোড়া কোনাকুনি করে চলত। এখন যতটা সম্ভব নজর এড়ানোর চেষ্টায় লম্বা চাদর মুড়ি দিয়ে মাত্র একজন মুরিদ নিয়ে তিনি পালাচ্ছেন, তার চাদরের নিচ দিয়ে একটা রাইফেলের নল বের হয়ে আছে আর তার কালো চোখের দৃষ্টি পথে দেখা লোকদের মুখ ভেদ করে গেছে।
গ্রামটিতে ঢোকার সময় যে রাস্তা গ্রামের খোলা চত্বরে নিয়ে যায়, হাজি মুরাদ সেটায় যাননি, বামে ঘুরে একটা চাপা গলি ধরলেন; পাহাড়ের ঢালে কাটা দ্বিতীয় মাটির কুঁড়েটার কাছে গিয়ে থেমে এবং চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। সামনের বারান্দাটায় কেউ ছিল না; কুঁড়েঘরটার চালে সদ্য লেপা মাটির চিমনিটার পেছনে একটা লোক ভেড়ার চামড়ায় বানানো গরম কাপড় গায়ে শুয়ে ছিল। হাজি মুরাদ তার চামড়ায় মোড়া চাবুকটার হাতল দিয়ে লোকটাকে স্পর্শ করলেন এবং জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করলেন। নিচ থেকে একটা বুড়ো লোক বের হয়ে এল, তার গায়ে তেলচিটে পুরান বেশমেত (ককেশীয় অঞ্চলে ব্যবহৃত কাফতান-জাতীয় পোশাক আর মাথায় ঘুমানোর টুপি। তার ভেজা লাল চোখের পাতায় কোনো পাপড়ি ছিল না, সেগুলোর জোড়া ছাড়ানোর জন্য সে পিটপিট করল। হাজি মুরাদ আসোলামু আলাইকুম বলে তার মুখের চাদর সরালেন। ওয়ালাইকুম আসোলাম বলল বুড়ো লোকটি। হাজি মুরাদকে চিনতে পেরে সে হাসল ফোকলা মুখে; তার পাতলা পা দুটোয় ভর করে উঠে সে চিমনির পাশে রাখা কাঠের খড়মে পা দুটো গলাতে শুরু করল। তারপর অলসভাবে তার ভেড়ার চামড়ার দোমড়ানো গরম কাপড়টিতে হাত ঢুকিয়ে দিল, চালের সঙ্গে ঠেস দেওয়া মইটার কাছে গিয়ে সে পেছন ফিরে নেমে এল। কাপড় পরা এবং নেমে আসার সময় তার রোদে পোড়া কোঁচকানো চিকন ঘাড়ের ওপর মাথাটা সে নাড়াচ্ছিল আর ফোকলা মুখে বিড়বিড় করছিল। মাটিতে নেমেই সে হাজি মুরাদকে সাদরে নামানোর জন্য তার ঘোড়ার লাগাম এবং ডান দিকের পাদানিতে হাত দিল; কিন্তু হাজি মুরাদের সঙ্গী করিতকর্মা জোয়ান মুরিদটি লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে বুড়োকে ইশারায় এক পাশে সরিয়ে দিয়ে নিজে তার জায়গা নিল। হাজি মুরাদও নেমে একটু খুঁড়িয়ে হেঁটে বারান্দার নিচে বসলেন। ঘরের দরজা দিয়ে বছর পনেরোর একটি ছেলে তাড়াতাড়ি বের হয়ে বঁইচির মতো কালো স্থির চোখে অতিথিদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
হাজি মুরাদের জন্য ক্যাঁচক্যাঁচে পাতলা দরজাটা খুলতে খুলতে বুড়ো লোকটি ছেলেটাকে হুকুম করল, দৌড়ে মসজিদে গিয়ে তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়।
বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকতেই হাজি মুরাদ দেখলেন, লাল বেশমেতের ওপর ঘন কুঁচি দেওয়া জামা এবং চওড়া নীল পায়জামা পরা হালকা-পাতলা গড়নের এক মধ্যবয়সী মহিলা ভেতরের দরজা দিয়ে বের হয়ে আসছে, হাতে তার কয়েকটি তাকিয়া।
আপনার আগমন আমাদের জন্য সুখ নিয়ে আসুক! বলে সে শরীরটা ধনুকের মতো বাকিয়ে নিচু হয়ে অতিথির বসার জন্য সামনের দিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে তাকিয়াগুলো সাজাতে লাগল।