আমাকে ওইভাবে রাখে ছয় দিন, তিনি বলে চলেন। সাত দিনের দিন আমাকে নিয়ে তারা তেমির-খান-শুরার দিকে রওনা হয়। চল্লিশজন সৈন্য। তাদের হাতে গুলিভর্তি বন্দুক। আমার হাত বাঁধা। আমি জানতাম, পালাতে চেষ্টা করলে তারা আমাকে মেরে ফেলবে।
আমরা মানসুহার কাছে পৌঁছালে পথটা খুব সরু হয়ে যায়। ডান দিকে একটা খাদ। প্রায় এক শ বিশ গজ গভীর। আমি ডান দিকে প্রায় কিনারে চলে গেলাম। একজন সৈন্য আমাকে থামাতে চেষ্টা করল। কিন্তু আমি তাকে টেনে সঙ্গে নিয়ে লাফ দিলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আর আমি, দেখতেই পাচ্ছ, এখনো বেঁচে আছি।
পাঁজর, মাথা, হাত, পা সব ভেঙে গিয়েছিল! হামাগুড়ি দিতে চেষ্টা শরীর রক্তে ভেজা। একজন রাখাল আমাকে দেখতে পেয়েছিল। সে কিছু লোক জড়ো করে আমাকে একটা গ্রামে নিয়ে গেল। আমার পাজর আর মাথা সেরে গিয়েছিল। পা-ও। শুধু একটু খাটো হয়ে গেল, বলে হাজি মুরাদ তার খাটো পাটি মেলে দিলেন। এখনো এটা কাজ করে, ওটাই যথেষ্ট।
লোকজন খবর পেয়ে আমার কাছে আসতে লাগল। আমি সুস্থ হয়ে তসেলমেসে গেলাম। আভাররা আমাকে আবার তাদের শাসনভার নিতে বলল, হাজি মুরাদ শান্ত এবং আস্থার সুরে বললেন, আমি রাজি হলাম।
হাজি মুরাদ উঠে দাঁড়িয়ে জিনের থলে থেকে একটা ফোলিও বের করলেন। তার ভেতর থেকে দুটো রংচটা চিঠি বের করে একটা লরিস মেলিকভের হাতে দিলেন। জেনারেল ক্লুগেনুর লেখা। লরিস-মেলিকভ প্রথম চিঠিটা পড়ল। ওতে লেখা ছিল–
লেফটেন্যান্ট হাজি মুরাদ। তুমি আমার অধীনে কাজ করেছ এবং আমি তোমার ওপর সন্তুষ্ট। তোমাকে ভালো লোক মনে করি।
সম্প্রতি আহমেদ খান আমাকে জানিয়েছে যে তুমি একজন বিশ্বাসঘাতক, তুমি পাগড়ি নিয়েছ এবং শামিলের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে। তুমি লোকজনকে রুশ সরকারকে অমান্য করার শিক্ষা দিচ্ছ। আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করে আমার কাছে আনার আদেশ দিয়েছি। কিন্তু তুমি পালিয়ে গিয়েছ। জানি না এতে তোমার ভালো হবে কি না, যেমন আমি জানি না তুমি দোষী না নির্দোষ।
এখন আমার কথা শোনো। তোমার বিবেক পরিষ্কার থাকলে, তুমি মহান জারের ব্যাপারে দোষী না হলে আমার কাছে এসো। কাউকে ভয় কোরো না। আমি তোমার রক্ষক। খান তোমার কিছুই করতে পারবে না। সে নিজে আমার অধীন, তাই তোমার ভয় করার কিছু নেই।
ক্লুগেনু আরও লিখেছিল যে সে সব সময় তার কথা রাখে এবং ন্যায়বিচার করে, সে আবারও হাজি মুরাদকে তার সামনে হাজির হতে পরামর্শ দেয়।
লরিস-মেলিকভের পড়া শেষ হলে হাজি মুরাদ দ্বিতীয় চিঠিটা দেওয়ার আগে তিনি প্রথমটার কী জবাব দিয়েছিলেন বলেন।
আমি লিখেছিলাম, আমি শামিলের জন্য পাগড়ি পরি না। আমার আত্মার জন্য, মুক্তির জন্য পরি। আমি শামিলের কাছে যেতে চাই না বা পারিও না। কারণ সে আমার বাবা, আমার ভাই এবং আত্মীয়দের মৃত্যুর কারণ। কিন্তু আমি রুশদের সঙ্গেও যোগ দিতে পারি না। কারণ, তারা আমার অসম্মান করেছে। (খুনজাখে আমাকে যখন বেঁধে রাখা হয়েছিল, তখন এক হারামজাদা আমার ওপর থুতু ছিটিয়েছিল। ওই লোকটাকে না মারলে আমি আপনার সঙ্গে যোগ দিতে পারি না। তার ওপর আমি মিথ্যুক আহমেদ খানকে ভয় পাই।
তখন জেনারেল আমাকে এই চিঠিটি লেখেন, রংচটা দ্বিতীয় চিঠিটি লরিস-মেলিকভের হাতে দিয়ে বললেন হাজি মুরাদ।
তুমি আমার প্রথম চিঠির জবাব দিয়েছ বলে ধন্যবাদ। লরিস-মেলিকভ পড়ছিল। তুমি লিখেছ, তুমি ফিরে আসতে ভীত নও। কিন্তু একজন অমুসলমান তোমাকে অপমান করায় আসতে পারছ না। কিন্তু আমি আশ্বস্ত করতে পারি, রুশ আইনে ন্যায়বিচার হয়। তুমি দেখতে পাবে তোমার চোখের সামনে অপমানকারীর শাস্তি হবে। আমি এরই মধ্যে ঘটনাটা তদন্তের আদেশ দিয়েছি।
কথা শোনো, হাজি মুরাদ! আমার কথা এবং আমার ওপর বিশ্বাস না করার জন্য তোমার ওপর অসন্তুষ্ট হওয়ার অধিকার আমার আছে। কিন্তু আমি ক্ষমা করে দিচ্ছি। কারণ, আমি জানি পাহাড়িদের সন্দেহবাতিক কেমন। তোমার বিবেক যদি পরিষ্কার হয় এবং তোমার পাগড়ি পরা যদি আত্মার মুক্তির জন্য হয়, তাহলে তুমি ঠিক। এবং আমার ও রুশ সরকারের দিকে সরাসরি তাকাতে পারবে। যে তোমার অপমান করেছে, তার শাস্তি হবে, কথা দিচ্ছি। তোমার সম্মান তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তুমি দেখবে রুশ আইন কী। তার ওপর আমরা রুশরা সবকিছু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখি। কোনো বদমাশ তোমার অপমান করেছে বলে আমাদের কাছে তোমার দাম কমে যায়নি।
আমি নিজে শিমরিস্তদের পাগড়ি পরার অনুমতি দিয়েছি। আমি তাদের কাজ-কারবার সঠিক দৃষ্টিতে দেখি। তাই আমি আবারও বলছি, তোমার ভয়ের কিছু নেই। যে লোকটার মাধ্যমে এই চিঠি পাঠাচ্ছি, তার সঙ্গে আমার কাছে এসো। সে আমার বিশ্বস্ত এবং তোমার শত্রুদের দাস নয়। সরকারের বিশেষ সুবিধা পায়, এমন একজনের বন্ধু।
ক্লুগেনু হাজি মুরাদকে তার কাছে যেতে রাজি করানোর জন্য আরও অনেক কিছু লিখেছে।
আমি তাকে বিশ্বাস করিনি, লরিস-মেলিকভ পড়া শেষ করলে হাজি মুরাদ বললেন। ক্লুগেনুর কাছে যাইনি। আহমেদ খানের ওপর নিজে প্রতিশোধ নেওয়াই আমার কাছে বড় ছিল। রুশদের মাধ্যমে আমি তা করতে পারতাম না। তখন আহমেদ খান তসেলমেস ঘেরাও করে আমাকে ধরতে বা মেরে ফেলতে চায়। আমার তখন গুটিকয় লোক। তাকে ঠেকাতে পারতাম না। ঠিক তখন আমার কাছে একজন দূত এল শামিলের চিঠি নিয়ে। আহমেদ খানকে পরাজিত করে মেরে আমাকে পুরো আভারের শাসনভার দেওয়ার প্রস্তাব। আমি অনেকক্ষণ চিন্তা করে শামিলের কাছে যাই। তারপর থেকে সব সময় রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি।