হাজি মুরাদসহ অন্যরা নিজেদের মনের কথা গোপন রাখতে জানে, কিন্তু এই লোকটি তা করতে না পেরে তাদের সঙ্গে বেইমানি করছে, লরিস মেলিকভ ভাবল।
লরিস-মেলিকভ তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। তাকে জিজ্ঞেস করল একঘেয়ে লাগছে কি না। হাতের কাজ না থামিয়ে সে ঘেৎ ঘোঁৎ করে জবাব দিল, না, লাগছে না। আড়চোখে সে লরিস-মেলিকভকে দেখে নিল। লরিস মেলিকভের সব প্রশ্নের জবাব দিল সে একইভাবে।
লরিস-মেলিকভ ঘরে থাকতেই হাজি মুরাদের আরেক আভার মুরিদ খানেফি ঘরে ঢোকে। তার মুখ, ঘাড় ও চওড়া বুক এত রোমশ যে মনে হয় শেওলাটাকা। সে সবল, কঠোর পরিশ্রমী ও সব সময় কাজে নিবিষ্ট। এলডারের মতো সে-ও প্রশ্নাতীতভাবে মনিবের বাধ্য।
কিছু চাল নেওয়ার জন্য ঘরে ঢুকলে লরিস-মেলিক তাকে থামিয়ে জানতে চাইল বাড়ি কোথায় এবং কত দিন ধরে হাজি মুরাদের সঙ্গে আছে।
পাঁচ বছর, বলল খানেফি। আমাদের বাড়ি একই গ্রামে। আমার বাবা তার চাচাকে খুন করে। তারা আমাকে খুন করতে চেয়েছিল, শান্ত গলায় বলল খানেফি। তার জোড়া ভুরুর নিচের চোখ দুটো দিয়ে সোজাসুজি লরিস মেলিকভের মুখের দিকে তাকিয়ে। তখন আমি তাকে ধর্মভাই ডাকি!
ধর্মভাই কী?
আমি দুই মাস আমার চুল-নখ কাটা বন্ধ করে তাদের কাছে আসি। তারা আমাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যায়। সে আমাকে তার বুকের দুধ দেয়। আর আমি তার ভাই হয়ে গেলাম।
পাশের ঘরে হাজি মুরাদের গলা শোনা যাচ্ছিল। এলডার তার ডাকে জবাব দিয়ে তাড়াতাড়ি হাত মুছে বসার ঘরে গেল।
আপনাকে যেতে বলেছে, ফিরে এসে সে বলল।
লরিস-মেলিকভ আমুদে খান মাহোমাকে আরেকটা সিগারেট দিয়ে বসার ঘরে চলে গেল।
১৩
লরিস-মেলিকভ বসার ঘরে এলে হাজি মুরাদ উজ্জ্বল হাসি হেসে তাকে স্বাগত জানালেন।
আমরা শুরু করব? গদিতে আরাম করে বসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ, অবশ্যই, বলল লরিস-মেলিকভ। তোমার লোকদের সঙ্গে কথা বলছিলাম…একজন বেশ মজার!
হ্যাঁ, খান মাহোমা একটু চপল স্বভাবের।
তরুণ সুদর্শন ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
ওহ, এলডার। সে তরুণ কিন্তু বেশ শক্ত–লোহায় বানানো।
তারা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।
তাহলে আমি শুরু করি!
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
তোমাকে বলেছি খানদের কীভাবে খুন করা হয়েছে…। তাদের খুন করে হামজাদ খুনজাখে এসে তাদের প্রাসাদ দখল করল। পরিবারের একমাত্র বেগম সাহেবাই বেঁচে ছিলেন। হামজাদ তাকে ধরে আনতে গেলে তিনি বাধা দেন। তখন হামজাদের ইশারায় তার মুরিদ আসেলদার পেছন থেকে ছুরি মেরে তাকে হত্যা করে।
তাকে হত্যা করল কেন? লরিস-মেলিকভের প্রশ্ন।
সে আর কী করতে পারত? সামনের পাগুলো যেদিকে যাবে, পেছনের পাকেও সেদিকেই যেতে হবে। সে পুরো পরিবারকে মেরে ফেলল। শামিল ছোট ছেলেটাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ছুঁড়ে ফেলল…
তারপর পুরো আভার হামজাদের কাছে নত হলো। কিন্তু আমার ভাই আর আমি ধরা দিলাম না। আমরা খানদের খুনের বদলে তাকে খুন করতে চেয়েছিলাম। আমরা ধরা দেওয়ার ভান করলাম কিন্তু আমাদের মাথায় এক চিন্তা, কীভাবে তাকে শেষ করব। আমার দাদার সঙ্গে আলাপ করলাম। ঠিক করলাম সে প্রাসাদের বাইরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর চোরাগোপ্তা হামলা করে তাকে খুন করব। কেউ একজন আমাদের কথা শুনে ফেলে হামজাদকে বলে দেয়। সে দাদাকে ধরে নিয়ে গেল। তাকে বলল, তোমার নাতিরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তুমি এবং তারা ঘরের আড়াকাঠে ঝুলবে। আমি আল্লাহর কাজ করছি। এতে বাধা
দাদা বাড়ি এসে আমাদের বলল।
আমার আর দেরি করতে চাইলাম না। ঠিক করলাম, মসজিদে ঈদের দিন কাজ শেষ করব। আমাদের সহযোগীরা আসতে চাইল না। কিন্তু আমি আর আমার ভাই অনড়।
আমরা দুটো করে পিস্তল চাদরের ভেতর নিয়ে মসজিদে গেলাম। হামজাদ মসজিদে ঢুকল জনা তিরিশেক মুরিদ নিয়ে। তাদের সবার হাতে তলোয়ার। তার সবচেয়ে প্রিয় মুরিদ আসেলদার (যে বেগম সাহেবার মাথা কেটে আলাদা করেছিল) আমাদের দেখে ফেলল। চিৎকার করে আমাদের চাদর খুলতে বলে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমার হাতের ছোরা দিয়ে তাকে খুন করে আমি হামজাদের দিকে ছুটে যাই। আমার ভাই ওসমান এর মধ্যেই তাকে গুলি করেছিল। কিন্তু সে মরেনি। ছোরা হাতে আমার ভাইয়ের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু মাথায় ছোরা মেরে আমি তাকে শেষ করে দিলাম। মুরিদ ছিল তিরিশজন আর আমরা মাত্র দুজন। তারা আমার ভাই ওসমানকে মেরে ফেলল। আমি তাদের ঠেকিয়ে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে এলাম।
হামজাদ খুন হয়েছে জানতে পেরে সব লোক বিদ্রোহ করল। মুরিদরা পালিয়ে গেল; যারা পালায়নি, তাদের মেরে ফেলা হলো।
একটু থেমে হাজি মুরাদ লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।
ওই পর্যন্ত ভালো ছিল, কিন্তু তারপর সব গোলমাল হয়ে গেল।
হামজাদের জায়গায় নিল শামিল। সে রুশদের বিরুদ্ধে আমাকে তার সঙ্গে যোগ দিতে খবর পাঠায়। আর আমি যদি না যাই, তাহলে সে খুনজাখ ধ্বংস করে আমাকে খুন করবে।
আমি যাব না জানিয়ে দিলাম আর বলে দিলাম, তাকেও আমার কাছে আসতে দেব না…।
তুমি তার সঙ্গে যোগ দিলে না কেন?
হাজি মুরাদ ভুরু কোচকালেন। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না।
আমি পারতাম না। আমার ভাই ওসমান আর আবু নুতসাল খানের রক্ত তার হাতে। আমি তার সঙ্গে যোগ দিলাম না। জেনারেল রোসেন আমাকে অফিসার বানিয়ে কমিশন দিলেন এবং আভার শাসন করতে বললেন। সেটা ভালোই ছিল। কিন্তু সেই রোসেনই প্রথমে মোহাম্মদ মির্জা, পরে আহমেদ খানকে কাজি-কুমুখের খান বানালেন। আহমেদ খান আমাকে ঘেন্না করত। সে বেগম সাহেবার মেয়ে সুলতানাকে তার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বেগম সাহেবা দেননি। আহমেদ মনে করত, আমি তা হতে দিইনি…হ্যাঁ, আহমেদ খান আমাকে ঘেন্না করত। আমাকে খুন করতে লোক পাঠিয়েছিল কিন্তু আমি পালিয়ে যাই। তারপর সে আমার বিরুদ্ধে জেনারেল ক্লুগেনুর কান ভারী করে। সে তাকে বলে যে রুশ সৈন্যদের কাঠ না দিতে আমি সবাইকে বলেছি। সে আরও বলে যে আমি এটা পরি (সে পাগড়িতে হাত দিয়ে দেখাল)। তার মানে আমি শামিলের সঙ্গে যোগ দিয়েছি। জেনারেল তার কথা বিশ্বাস করেননি। আমাকে টোকাও না দিতে আদেশ দিলেন। কিন্তু জেনারেল তিবলিসে গেলে আহমেদ খান তার ইচ্ছেমতো কাজ করে। আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য একদল সৈন্য পাঠায়। আমাকে শিকল দিয়ে কামানের সঙ্গে বেঁধে রাখে।