ঠিক আছে, বলে হাজি মুরাদ তার শোবার ঘরে চলে গেলেন।
ঘরে একা থাকায় লরিস-মেলিকভ হাজি মুরাদের কথাগুলো মিলিয়ে দেখল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। শোবার ঘরের দরজাটার উল্টো দিকের দরজার কাছে গিয়ে সে শুনতে পেল কয়েকজন লোক তাতারি ভাষায় উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। সে মনে করল, তারা হাজি মুরাদের মুরিদ। দরজা খুলে বের হয়ে সে তাদের কাছে গেল। ঘরটা পাহাড়িদের গায়ের কটু গন্ধে ভরে আছে। মেঝেয় একটা বিছানো চাদরের ওপর বসে একচোখা লালচুলো গামজালো বসে। গায়ে একটি তেলচিটে ছেঁড়াফাটা বেশমেত। সে লাগামের দড়ি পাকাতে পাকাতে উত্তেজিতভাবে হেঁড়ে গলায় কিছু বলছিল। লরিস-মেলিকভ ঘরে ঢুকলে সে থেমে গেল। তার দিকে কোনো নজর না দিয়ে সে হাতের কাজ চলিয়ে গেল। খোশমেজাজি খান মাহোমা দাঁড়িয়ে ছিল গামজালোর সামনে। তার সাদা দাঁতগুলো বের করে, তার কালো পাপড়িহীন চোখ চকচক করছিল। সে কোনো কিছু বলছিল বারবার। সুদর্শন এলডারের সবল বাহুর ওপর আস্তিন গোটানো। সে একটি পেরেকে ঝোলানো জিনের পেটি পালিশ করছিল। মূল সহকারী খানেফি সেখানে ছিল না। বাড়ি দেখাশোনার ভার তার ওপর। সে রান্নাঘরে খাবার রাঁধছিল।
তাদের সালাম দিয়ে লরিস-মেলিকভ জিজ্ঞেস করল, কী নিয়ে তর্ক করছ?
সে সব সময় শামিলের গুণ গায়, লরিস-মেলিকভের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল খান মাহোমা। সে বলে শামিল ভালো মানুষ, জ্ঞানী, পবিত্র এবং দক্ষ ঘোড়সওয়ার।
সে তাকে ছেড়ে এসেও কী করে তার প্রশংসা করে?
সে তাকে ছেড়ে এসেছে, তারপরও প্রশংসা করে। আবার বলল খান মাহোমা।
সে আসলেই শামিলকে পীর মনে করে? জিজ্ঞেস করল লরিস মেলিকভ।
সে পীর না হলে লোকে তার কথা শুনত না, গামজালোর চটজলদি জবাব।
শামিল না, মনসুর পীর ছিল, জবাব দিল খান মাহোমা। সে-ই ছিল আসল পীর। সে ইমাম থাকার সময় মানুষ অন্য রকম ছিল। সে ঘোড়ায় চড়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে গেলে লোকজন তার কাপড়ের কিনার ধরে চুমু খেয়ে পাপ স্বীকার করত এবং আর পাপ না করার ওয়াদা করত। মুরব্বিরা বলে, তখন সব মানুষ পীরদের মতো ছিল। মদ খেত না, সিগারেট খেত না, নামাজ বাদ দিত না, খুনোখুনি হলেও অন্যদের দোষ মাফ করে দিত। টাকাপয়সা কুড়িয়ে পেলে লাঠির আগায় বেঁধে রাস্তার পাশে ঝুলিয়ে রাখত। তখন আল্লাহ মানুষকে কামিয়াব করত–এখনকার মতো না।
পাহাড়িরা এখনো মদ-সিগারেট খায় না, বলল গামজালো।
তোমার শামিল একটা লামোরি, লরিস-মেলিকভের দিকে চোখ টিপে খান মাহোমা বলল। (লামারি মানেও পাহাড়ি, তবে খারাপ অর্থে।)।
হ্যাঁ, লামোরি মানেও পাহাড়ি, গামজালো বলল। যে পাহাড়ে ইগল থাকে।
দারুণ, ঠিক বলেছ! পাল্টা জবাবে খুশি হয়ে হেসে খান মাহোমা বলল।
লরিস-মেলিকভের হাতে সিগারেটের রুপার কৌটা দেখে খান মাহোমা একটা সিগারেট চাইল। লরিস-মেলিকভ চোখ টিপে হাজি মুরাদের ঘরের দিকে ইশারা করে বলল, সিগারেট খাওয়া তো নিষেধ। খান মাহোমার মন্তব্য,
দেখলে অসুবিধা নেই। সে সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটে টান দিয়ে না গিলে ধোয়া ছাড়তে শুরু করল। তার অনভ্যস্ত লাল ঠোঁট অদ্ভুত কায়দায় গোল করে।
এটা ঠিক নয়! জোরে বলে গামজালো ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
খান মাহোমা তার পেছনে আবার চোখ টিপল। সিগারেট টানতে টানতে লরিস-মেলিকভকে জিজ্ঞেস করল একটা রেশমি বেশমেত আর সাদা টুপি কোথায় ভালো পাওয়া যাবে।
তোমার কি অত টাকা আছে?
হ্যাঁ, কেনার মতো টাকা আছে।
জিজ্ঞেস করো টাকা সে পেল কোথায়, সুদর্শন মুখে হাসি ছড়িয়ে লরিস মেলিকভকে বলল এলডার।
আমি জিতেছি। খান মাহোমা চট করে জবাব দিল। তারপর বলল কেমন করে জিতেছে। আগের দিন তিবলিসে হাঁটতে গিয়ে রাস্তার ওপর কয়েকজন রুশ ও আর্মেনীয়কে অর্লিয়াঙ্কা (পয়সার এপিঠ-ওপিঠ ধরনের খেলা) খেলতে দেখে। বাজি ছিল তিনটি সোনার এবং অনেক রুপার টাকা। খান মাহোমা সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে যায়। তার পকেটের পয়সাগুলো ঝনঝন করে সব টাকা বাজি ধরার কথা জানায়।
তুমি কী করে করলে, তোমার কত ছিল? লরিস-মেলিকভ জিজ্ঞেস করল।
আমার কাছে ছিল বারো কোপেক, খ্যাক খ্যাক করে হেসে জবাব দিল খান মাহোমা।
বেশ, হারলে কী করতে?
কেন, এই দেখো! তার পিস্তলটি দেখিয়ে বলল খান।
তুমি ওটা দিয়ে দিতে?
দেব কেন? আমি দৌড় দিতাম, কেউ পিছু নিলে গুলি করে মেরে ফেলতাম…সব খতম!
তাহলে তুমি জিতেছ?
হ্যাঁ, আমি সব জিতে নিয়ে এসেছি!
লরিস-মেলিকভ বেশ বুঝে গেল খান মাহোমা, এলডার কেমন মানুষ। খান মাহোমা আমুদে, বেপরোয়া আর যেকোনো হইহল্লার জন্য প্রস্তুত। তার উপচে পড়া জীবনশক্তি নিয়ে কী করা উচিত, সে জানে না। সে সব সময়ই আনন্দে থাকে আর হঠকারী। নিজের ও অন্যদের জীবন নিয়ে খেলতে সে ভালোবাসে। জীবন নিয়ে খেলতেই সে রুশদের কাছে এসেছে। একই কারণে সে শামিলের সঙ্গেও যোগ দিতে পারে।
এলডারকে বোঝা সহজ। সে তার নেতার (মুরশিদ) প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত। শান্ত, সবল ও দৃঢ়।
একমাত্র গামজালোকে লরিস-মেলিকভ বুঝতে পারেনি। লোকটা কেবল শামিলের প্রতি বিশ্বস্ত নয়, রুশদের প্রতি তার অনীহা, অবজ্ঞা, বিরোধিতা ও ঘেন্না অদম্য। তাই সে বুঝতে পারেনি গামজালো কেন রুশদের কাছে এসেছে। লরিস-মেলিকভের মনে হলো হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণ, শামিলের সঙ্গে শত্রুতার গল্প প্রতারণাও হতে পারে। কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও সে রকম সন্দেহ করেন। হয়তো সে রুশদের দুর্বলতাগুলো জানার জন্য গোয়েন্দাগিরি করতেই আত্মসমর্পণ করেছে। হয়তো পাহাড়ি এলাকায় ফিরে গিয়ে তার বাহিনীকে সেভাবে কাজে লাগাবে। গামজালো লোকটি এই সন্দেহ পাকা করে দিল।