তিবলিস ঘুরে আসার পর আমার ধারণা বদলে যায়। আমি বুড়ি বেগম আর খানদের জিহাদে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিলাম।
তোমার মত বদলে গেল কেন? লরিস-মেলিকভ জিজ্ঞেস করল। তুমি রুশদের ওপর সন্তুষ্ট ছিলে না?
হাজি মুরাদ থামলেন। না, আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না, চোখ মুদে পরিষ্কার বললেন। আরেকটা কারণে আমি জিহাদে যোগ দিতে চেয়েছিলাম।
সেটা কী?
তসেলমেসের কাছে আমি ও উম্মা তিনজন মুরিদের মুখোমুখি হই। তাদের দুজন পালিয়ে যায়, তৃতীয়জনকে আমি পিস্তল দিয়ে গুলি করি।
আমি তার অস্ত্রগুলো নিতে কাছে গেলে দেখি সে বেঁচে আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে মেরে ফেলছ। আমি খুশি; কিন্তু তুমি
একজন মুসলমান, সবল তরুণ। জিহাদে যোগ দাও, আল্লাহ তাই চান!
এবং তুমি যোগ দিলে?।
না, কিন্তু কথাটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল, হাজি মুরাদ গল্পটা বলতে থাকলেন।
হামজাদ খুনজাখের দিকে এলে মুরব্বিদের তার কাছে পাঠালাম এই বলে যে আমরা জিহাদে যোগ দিতে রাজি আছি, যদি ইমাম আমাদের বোঝাতে একজন জ্ঞানী লোককে পাঠান। হামজাদ মুরব্বিদের গোঁফ কামিয়ে, নাকে ফুটো করে তাতে পিঠা ঝুলিয়ে দিল। এই অবস্থায় তাদের আমাদের কাছে ফেরত পাঠাল।
মুরব্বিদের কাছে বলে দিল যে সে জ্ঞানী কাউকে পাঠাতে পারে, যদি বেগম সাহেবা তার ছোট ছেলেকে জামিন হিসেবে পাঠান। তিনি তার কথা মেনে নিয়ে ছোট ছেলে বুলাচ খানকে পাঠিয়ে দিলেন। হামজাদ তাকে সাদরে গ্রহণ করে বড় দুই ভাইকেও দাওয়াত পাঠাল। সে বলে পাঠাল যে তার বাবা খানদের বাবাকে যেমন সেবা করেছে, সে-ও খানদের তেমন সেবা করতে চায় আর সব এক মহিলার মতো বেগমও একজন দুর্বল, বোকা ও অহংকারী ছিলেন। তিনি দুই ছেলেকেই পাঠাতে ভয় পেলেন এবং কেবল উম্মা খানকে পাঠালেন। আমি তার সঙ্গে গেলাম। পৌঁছার মাইলখানেক আগেই আমাদের সঙ্গে মুরিদদের দেখা হলো। তারা আমাদের ঘিরে গান গাইতে গাইতে ঘোড়া নিয়ে আধা বৃত্তে নাচল। কাছাকাছি গেলে হামজাদ তাঁবু থেকে বের হয়ে উম্মা খানের ঘোড়র পাদানি ধরে তাকে খানের মতো স্বাগত জানিয়ে নামাল। সে বলল, আমি তোমাদের পরিবারের কোনো ক্ষতি করিনি, করতেও চাই না। আমাকে মেরে ফেলো না, আর লোকদের জিহাদে নামানোর কাজে আমাকে বাধা দিয়ো না। আমি আমার পুরো বাহিনী দিয়ে তোমাদের সেবা করব, যেভাবে আমার বাবা তোমাদের বাবাকে সেবা করেছে। আমাকে তোমাদের বাড়িতে থাকতে দাও। আমি তোমাদের পরামর্শ দেব এবং তোমরা যা খুশি করতে পারবে।
উম্মা খান কথা বলতে পারছিল না, বুঝতে পারছিল না কী বলতে হবে। তাই সে চুপ করে থাকল। আমি বললাম, তা-ই যদি হয়, তাহলে হামজাদ খুনজাখে আসতে পারে। বেগম ও খানরা তাকে সাদরে বরণ করবে কিন্তু আমার কথা শেষ করতে দেওয়া হলো না, তখনই আমি শামিলকে প্রথম দেখি। সে ইমামের পাশে ছিল। সে আমাকে বলল, তোমাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, খান বলবে!
আমি চুপ করে গেলাম। হামজাদ উম্মা খানকে তার তাঁবুতে নিয়ে গেল। তারপর হামজাদ আমাকে ডেকে তার দূতদের নিয়ে খুনজাখে যেতে বলল। আমি সেখানে গেলাম। দূতরা তার বড় ছেলেকেও হামজাদের কাছে পাঠানোর জন্য বেগমকে বোঝাতে শুরু করল। আমার মনে হলো, সেটা বিশ্বাসঘাতকতা হবে। আমি তাকে বড় ছেলেকে পাঠাতে বারণ করলাম। কিন্তু মহিলাদের মাথায় ঘিলুর পরিমাণ খুবই কম। তিনি তার ছেলেকে যেতে বললেন। আবু নুতসাল খান যেতে চায়নি। তখন বেগম বললেন, বুঝেছি, তুমি ভিতু! তিনি মৌমাছির মতো জানতেন কোথায় হুল ফোঁটালে সে সবচেয়ে কাতর হবে। আবু নুতসাল খান লাল হয়ে গেল এবং বেগমের সঙ্গে আর কথা বলল না। তার ঘোড়া তৈরি করতে বলল। সঙ্গে গেলাম আমি।
হামজাদ আমাদের আরও সম্মান দেখাল। নিজে অভ্যর্থনা করল বন্দুকের দুই গুলি দূরত্বে নেমে এসে। বড় একটি অশ্বারোহী দল এবারও বাতাসে গুলি ছুড়ল, আমাদের ঘিরে গাইল এবং ঘোড়া নিয়ে আধা বৃত্তে নাচল।
শিবিরে পৌঁছালে খানকে নিয়ে তার তাঁবুতে চলে গেল হামজাদ আর আমি থাকলাম ঘোড়াগুলো নিয়ে।
আমি পাহাড়ের ঢালের অনেকটা নিচে থেকে হামজাদের তাঁবুতে গুলির আওয়াজ শুনলাম। দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখি, উম্মা খান রক্তে ভাসছে আর আবু নুতসাল মুরিদদের সঙ্গে লড়ছে। তার একটা গাল কেটে ঝুলছে। এক হাতে সেটা চেপে ধরে, আর অন্য হাতের ছোরা দিয়ে কাছে যে আসছে, তাকেই কোপাচ্ছে। হামজাদের ভাইকে কোপ মেরে ফেলে দিতে দেখলাম। আরেকজনকে আঘাত করতে গেলে মুরিদরা তাকে গুলি করে ফেলে দেয়।
হাজি মুরাদ থামলেন। তার রোদে পোড়া মুখ আর চোখ ভাটার মতো লাল।
আমি ভয়ে পালিয়ে এলাম।
সত্যি? আমি ভেবেছি তুমি ভিতু নও, লরিস-মেলিকভ বলল।
তারপর থেকে না, তারপর থেকে আমার সেই লজ্জার কথা মনে আছে। তা মনে পড়লে আমি আর কিছুই ডরাই না?
১২
বেশ, আর না! নামাজের সময় হয়েছে, বলে হাজি মুরাদ চাপকানের বুকপকেট থেকে ভরন্তসভদের দেওয়া ঘন্টা বাজানো ঘড়িটা (রিপিটার ঘড়ি) বের করে সাবধানে স্প্রিংয়ের ওপর চাপ দিলেন। সোয়া ১২টার ঘণ্টা বাজল। মাথাটা একদিকে কাত করে মুখে হালকা হাসি নিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো হাজি মুরাদ তা-ই শুনলেন।
বন্ধু ভরসভের উপহার, হেসে বললেন হাজি মুরাদ।
খুব ভালো ঘড়ি, লরিস-মেলিকভ বলল। তাহলে তুমি নামাজ পড়ো, আমি বসে আছি।