নাচের এই আসরে হাজি মুরাদ ভরন্তসভকে তার পরিবার সম্পর্কে বলার চেষ্টা করল; কিছুই শুনতে পাননি, এমন ভাব করে ভরন্তসভ চলে গেলেন। পরে লরিস-মেলিকভ হাজি মুরাদকে বলল যে তখন কাজের কথা বলার উপযুক্ত সময় নয়।
১১টা বাজলে হাজি মুরাদ ভরন্তসভদের দেওয়া ঘড়িতে সময় দেখে লরিস-মেলিকভকে জিজ্ঞেস করল সে যেতে পারে কি না। লরিস-মেলিকভ বলল সে যেতে পারে কিন্তু থেকে যাওয়া ভালো। তা সত্ত্বেও হাজি মুরাদ থাকলেন না; তার ব্যবহারের জন্য দেওয়া ফিটন গাড়িতে চড়ে তাকে দেওয়া বাড়িতে চলে গেলেন।
১১
তিবলিসে হাজি মুরাদের পাঁচ দিনের দিন ভাইসরয়ের আদেশে তার এডিসি লরিস-মেলিকভ হাজি মুরাদের সঙ্গে দেখা করতে এল।
আমার মাথা ও হাত সরদারের সেবা করতে আনন্দিত, হাজি মুরাদ তার স্বাভাবিক কূটনৈতিক সৌজন্যে তার মাথা নিচু করে এবং দুহাত বুকের ওপর রেখে বললেন। নম্রভাবে লরিস-মেলিকভের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আদেশ করুন!
লরিস-মেলিকভ টেবিলের পাশে রাখা একটা আরামকেদারায় বসলেন, হাজি মুরাদ বসলেন তার উল্টো দিকের একটি গদিতে, হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে। অন্যজনের কথা ভালো করে শোনার জন্য তিনি মাথা কাত করে ছিলেন।
লরিস-মেলিকভ বললেন হাজি মুরাদের অতীত সম্বন্ধে প্রিন্স জানলেও এখনকার অবস্থা পুরোপুরি জানতে চান। লরিস-মেলিকভ স্বচ্ছন্দে তাতার বলতে পারতেন।
আমাকে বলুন, আমি লিখে নিয়ে তা রুশ ভাষায় অনুবাদ করে দিলে প্রিন্স সেটা সম্রাটের কাছে পাঠিয়ে দেবেন।
হাজি মুরাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন (অন্যে কথা বলতে থাকলে তিনি কখনো থামান না এবং যে বলছিল, তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চুপ করে থাকেন এই ভেবে যে অন্যজন হয়তো আরও কিছু বলবে)। তারপর তিনি মাথা তুলে টুপিটা নেড়ে বসালেন এবং তার সেই অদ্ভুত শিশুসুলভ হাসি হাসলেন, যে হাসি মারিয়া ভাসিলিয়েভনাকে মুগ্ধ করেছে।
সম্রাট তার কাহিনি পড়বেন, এই ভেবে খুশি হয়ে বললেন, আমি বলব।
তুমি আমাকে সব বলবে, (তাতার ভাষায় সম্মানসূচক তুমি নেই, তাই সাধারণ তুমিই তিনি বললেন) সব বলবে, একদম প্রথম থেকে, বলে লরিস-মেলিকভ একটা নোটবই বের করলেন।
আমি বলব, কিন্তু সে তো অনেক অনেক কথা। কত ঘটনা ঘটেছে, হাজি মুরাদ বললেন।
তুমি সব এক দিনে বলতে না পারলে আরও সময় নিতে পারো, বললেন। লরিস-মেলিকভ।
আমি কি একদম গোড়া থেকে শুরু করব?
হ্যাঁ, একদম গোড়া থেকে–তোমার জন্ম, তুমি যেখানে থাকতে, সেখান থেকে।
হাজি মুরাদ অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তারপর গদির পাশে রাখা একটা লাঠি হাতে নিলেন। খাপ থেকে হাতির দাঁতের ওপর সোনায় খোদাই করা হাতলের একটি ক্ষুরধার ছোরা বের করলেন। তারপর ছোরাটি দিয়ে লাঠিটার ওপর অল্প অল্প করে কাটতে আর কথা বলতে শুরু করলেন।
লিখুন : জন্ম তসেলমেস গ্রামের ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে। আমরা পাহাড়িরা যাকে গাধার মাথার মতো ছোট বলি, বললেন তিনি। এর থেকে খুব বেশি দূরে নয়, কামানের দুই গোলার প্রায় সমান দূরে ছিল খুনজাখ। সেখানে খানরা থাকত। তাদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল।
আমার সবচেয়ে বড় ভাই ওসমানের যখন জন্ম হয়, আমার মা তখন সবচেয়ে বড় খান আবু নুতসাল খানের দুধ-মা ছিলেন। তারপর তিনি খানের দ্বিতীয় ছেলে উম্মা খানকেও পেলে বড় করেন। আমার দ্বিতীয় ভাই আহমেদ তখন মারা যায়। আমার জন্ম হওয়ার সময় খান সাহেবের বেগম বুলাচ খানকে পেটে ধরেন। আমার মা তখন আর দাই হিসেবে যাননি। বাবা তাকে যেতে বলেছিলেন কিন্তু মা যাননি। তিনি বলেছিলেন, আমি আমার আরেকটা ছেলেকে মেরে ফেলব না; আমি যাব না। আমার জেদি বাবা তখন তাকে ছোরা বসিয়ে দেন। সবাই তাকে বাবার হাত থেকে না বাঁচালে তিনি মরেই যেতেন। মা আমাকে ছেড়ে যাননি, তারপর তিনি একটা গান বানিয়েছিলেন, কিন্তু আমি সেটা বলব না।
আমার মা দাই-মা হিসেবে গেলেন না, মাথা ঝাঁকিয়ে তিনি বললেন, খান সাহেবের বেগম আরেকজন দাই জোগাড় করেন। কিন্তু আমার মাকে তিনি পছন্দ করতেন। মা আমাদের নিয়ে তাদের বাড়িতে যেতেন। আমরা তার ছেলেদের সঙ্গে খেলতাম, তিনি আমাদেরও আদর করতেন।
খানদের তিন ছেলে : আবু নুতসাল খান, আমার ভাই ওসমানের পালক ভাই উম্মা খান এবং আমার ধর্মভাই বুলাচ খান। বুলাচ সবচেয়ে ছোট, শামিল তাকে খাড়া পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছিল, সেটা পরের কথা।
আমার বয়স যখন খোলো, মুরিদরা তখন গ্রামে আসতে শুরু করে। তারা পাথরের ওপর কাঠের খঞ্জর (ছোট বাঁকা তরবারি) দিয়ে শব্দ করত আর চিৎকার করে বলত, মুসলমানরা, জিহাদ আসছে! চেচেনরা মুরিদদের সঙ্গে যোগ দিল। আভাররাও যেতে শুরু করে। আমি তখন প্রাসাদে থাকতাম খানদের ভাই হিসেবে। আমি যা খুশি করতে পারতাম। বেশ ধনী হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ঘোড়া, অস্ত্র ও টাকা-সবই ছিল। আমি তখন বেপরোয়া, ফুর্তিতে জীবন কাটাই। এ রকম চলছিল ইমাম কাজি-মোল্লা নিহত হওয়া পর্যন্ত। তার জায়গায় এল হামজাদ। হামজাদ খানদের কাছে দূত পাঠিয়ে জানাল তারা জিহাদে যোগ না দিলে খুনজাখ ধ্বংস করে দেওয়া হবে।
এটা ভাবনার বিষয় ছিল। খানরা রুশদের ভয় করত। জিহাদে যোগ দিতেও ভয় করত। বুড়ি বেগম আমাকে আর তার দ্বিতীয় ছেলে উম্মা খানকে তিবলিসে পাঠালেন। হামজাদের বিরুদ্ধে রুশ সেনাপতির সাহায্যের আশায়। তিবলিসে রুশ সেনাপতি ছিলেন ব্যারন রোজেন। তিনি আমার বা উম্মা খানের সঙ্গে দেখা করলেন না। তিনি সাহায্যের কথা বলে পাঠালেন, কিন্তু কিছুই করলেন না। শুধু কয়েকজন ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে এলেন আর উম্মা খানের সঙ্গে তাস খেলে গেলেন। তারা তাকে মদ খাইয়ে মাতাল করে খারাপ সব জায়গায় নিয়ে যেতেন। উম্মা খান তাদের কাছে তাস খেলায় সব হারান। তিনি ছিলেন ষাঁড়ের মতো জোয়ান, সিংহের মতো সাহসী কিন্তু তার মন ছিল খুব নরম। আমি তাকে বাধা না দিলে তিনি জুয়ায় তার সবকিছু হারাতেন।