বিশাল টেবিল এবং ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ড টানানো বড় বড় জানালার ঘরটিতে ঢুকে হাজি মুরাদ তার রোদে পোড়া ছোট হাত দুটো দিয়ে চাপকানের পাশ দুটো মেলার জায়গায় স্পর্শ করলেন। তারপর চোখ নামিয়ে তাড়াহুড়া না করে তার ভাষায় স্পষ্টভাবে শ্রদ্ধাভরে কথা বলতে শুরু করলেন কুমিক আঞ্চলিক টানে, এই টানটি তিনি ভালো বলতে পারেন।
আমি মহান জারের প্রবল ক্ষমতা এবং আপনার কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছি, তিনি বললেন, এবং কায়মনে আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে জারের সেবা করার প্রতিজ্ঞা করছি, এবং আমি আশা করি আপনাদের এবং আমার শত্রু শামিলের সঙ্গে যুদ্ধে আমি কাজে লাগতে পারব।
দোভাষীর কথা শোনার পর ভরন্তসভ হাজি মুরাদের দিকে তাকালেন, হাজি মুরাদও তার দিকে তাকালেন।
দুজনের চোখে চোখে এত কথা হয়ে গেল, যা বলা যেত না এবং দোভাষীও তা কিছুতেই বোঝাতে পারত না। কোনো শব্দ ব্যবহার না করে তারা একে অন্যকে পুরো সত্য বলে দিল। ভরসভের চোখ বলল হাজি মুরাদ যা বলেছেন, তার একটি শব্দও তিনি বিশ্বাস করেননি এবং তিনি জানেন হাজি মুরাদ যেকোনো রুশ জিনিসের শত্রু ছিলেন এবং থাকবেন, এখন আত্মসমর্পণ করছেন বাধ্য হয়ে। হাজি মুরাদ তা বুঝতে পারলেও নিজের সততা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে থাকলেন। তার চোখ বলেছিল, বুড়ো তার যুদ্ধের নয়, তার মৃত্যুর কথা ভাবছে; বুড়ো ধূর্ত তাই তাকে সাবধান হতে হবে। ভরন্তসভ এটাও বুঝতে পেরেছিলেন, তা সত্ত্বেও হাজি মুরাদের সঙ্গে যুদ্ধে জেতার ব্যাপারে কথা বললেন।
তাকে বলো, ভরন্তসভ বললেন, আমাদের জার যেমন পরাক্রমশালী, তেমনি দয়ালু এবং হয়তো আমার অনুরোধে তাকে ক্ষমা করে দিয়ে কাজে লাগাতে পারে…বলেছ তাকে? হাজি মুরাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আমার ঊর্ধ্বতনের সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত তাকে আমার কাছে রেখে দেব এবং আমাদের সঙ্গে ভালোভাবে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করব। হাজি মুরাদ আবার তার বুকের কাছে হাত রেখে উৎফুল্লভাবে কিছু বলতে শুরু করলেন।
দোভাষী বলল, তিনি বলছেন ১৮৩৯ সালে আভারিয়ার শাসক থাকার সময় তিনি রুশদের বিশ্বস্তভাবে সেবা করেছেন এবং তার শত্রু আহমেদ খান তার ক্ষতি করার জন্য জেনারেল ক্লুগেনুর কাছে তার দুর্নাম না করা পর্যন্ত রুশদের ছেড়ে যাননি।
ভরন্তসভ বললেন, জানি জানি, (যেন তিনি তা আগে থেকেই জানতেন, কিন্তু ভুলে গিয়েছিলেন)। জানি, বলে ভরন্তসভ হাজি মুরাদকে দেয়ালের পাশের সোফায় বসতে ইশারা করলেন। কিন্তু হাজি মুরাদ বসলেন না। একজন গুরুত্বপূর্ণ লোকের সামনে বসবেন কি না, মনস্থির করতে পারছেন না, তার শক্তিশালী কাধ নাড়িয়ে বোঝালেন হাজি মুরাদ।
তারপর দোভাষীর মাধ্যমে বলতে শুরু করলেন, আহমেদ খান ও শামিল–দুজনেই আমার শত্রু। প্রিন্সকে বলল যে আহমেদ খান মৃত আর আমি তার ওপর প্রতিশোধ নিতে পারি না; কিন্তু শামিল বেঁচে আছে, তার ওপর প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত আমি মরব না, জেদে ভুরু কুঁচকে মুখ শক্ত করে বললেন হাজি মুরাদ।
হ্যাঁ, হ্যাঁ; কিন্তু তিনি কী করে শামিলের ওপর প্রতিশোধ নেবেন? শান্তভাবে ভরন্তসভ বললেন দোভাষীকে। তাকে বলে তিনি বসতে পারেন।
হাজি মুরাদ আবারও বসতে অস্বীকার করলেন; প্রশ্নের জবাবে বললেন রুশদের কাছে তার আসার উদ্দেশ্য শামিলকে ধ্বংস করতে তাদের সাহায্য করা।
বেশ, বেশ, কিন্তু তিনি ঠিক কী করতে চান? ভরন্তসভ বললেন, বসুন, বসুন।
হাজি মুরাদ বসে বললেন একদল সৈন্য সঙ্গে দিয়ে তাকে লেসগিয়ার সীমায় পাঠিয়ে দিলে তিনি নিশ্চিতভাবে দাগেস্তান দখলে নিতে পারবেন এবং শামিলের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
চমৎকার হবে। আমি ভেবে দেখব, ভরন্তসভ বললেন।
দোভাষী তা বুঝিয়ে দিল।
হাজি মুরাদ চিন্তায় পড়লেন।
সরদারকে আরেকটা কথা বলো, হাজি মুরাদ আবার শুরু করলেন। আমার পরিবার আমার শত্রুর হাতে। তারা যত দিন সেখানে থাকবে, তত দিন আমি কিছু করতে পারব না। আমি প্রকাশ্যে বিরুদ্ধে গেলে শামিল আমার স্ত্রী, আমার মা এবং সন্তানদের মেরে ফেলবে। প্রিন্স আগে বন্দীদের বদলে আমার পরিবারকে ছাড়িয়ে আনলে আমি পরে শামিলকে শেষ করে দেব, না হয় মরে যাব!
ঠিক আছে, ঠিক আছে, ভরন্তসভ বললেন। আমি ভেবে দেখব। এখন তাকে সেনাপ্রধানের কাছে গিয়ে তার অবস্থা ও পরিকল্পনা বলতে বলো।
হাজি মুরাদ ও ভরন্তসভের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ এভাবেই শেষ হলো।
সন্ধ্যায় প্রাচ্যরীতিতে সাজানো নতুন থিয়েটারে একটি ইতালীয় অপেরা মঞ্চস্থ হচ্ছিল। ভরন্তসভ তার কুঠুরিতে বসে ছিলেন। তখন মঞ্চের কাছের আসনগুলোর দিকে খুঁড়িয়ে চলা হাজি মুরাদের চোখে পড়ার মতো পাগড়ি মাথায় অবয়ব দেখা গেল। ভরন্তসভের এডিসি লরিস-মেলিকভের সঙ্গে তিনি এসেছিলেন। লরিস-মেলিকভের ওপর তার দেখাশোনার ভার পড়েছিল। হাজি মুরাদ সামনের সারির একটি আসনে বসলেন। প্রথম অঙ্কের সময়টা প্রাচ্যের ভাবলেশহীন, নিরানন্দ কঠোর-মুখো অভিজাত মুসলমানদের মধ্যে কাটিয়ে হাজি মুরাদ উঠে দাঁড়ালেন এবং চারদিকের দর্শকদের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বের হয়ে গেলেন।
পরদিন সোমবার, ভরসভের বাড়িতে নিয়মিত ভোজের আয়োজন। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বিশাল ঘরে গাছগুলোর আড়ালে বাদকদল বাজাচ্ছিল। তরুণী এবং ততটা তরুণী নয় মহিলারা বুক, বাহু ও কাঁধের ওপরের দিক খোলা পোশাকে ঝকঝকে সামরিক পোশাক পরা পুরুষদের জড়িয়ে কেবল ঘুরছিল আর ঘুরছিল। খাবার সাজানো টেবিলে লাল হংসপুচ্ছ কোট এবং হাঁটু পর্যন্ত আঁটা পাতলুন ও জুতা পরা খানসামারা মহিলাদের শ্যাম্পেন ও মিষ্টি খাবার বেঁটে দিচ্ছিল। বয়স হওয়া সত্ত্বেও সরদারের স্ত্রী তেমনি আধো পোশাকে আমন্ত্রিতদের ঘুরে ঘুরে যাচ্ছিলেন। শিষ্ট হাসিমুখে দোভাষীর মাধ্যমে নির্বিকারভাবে অতিথিদের দিকে তাকিয়ে থাকা হাজি মুরাদকে ভদ্রভাবে দু-একটি কথা বললেন। গৃহকতাঁর পর অন্যান্য আধা উলঙ্গ মহিলারা হাজি মুরাদের কাছে এসে নিঃসংকোচে তার সামনে দাঁড়িয়ে একই প্রশ্ন করল : সবকিছু কেমন লাগছে? কাঁধে সোনালি বিহ্ন ও পাকানো রঞ্জু এবং গলায় তার হোয়াইট ক্রস ঝুলিয়ে ভরন্তসভও তার কাছে এসে একই প্রশ্ন করলেন। স্পষ্টত নিশ্চিত হয়ে যে যা দেখছে তা ভালো না লেগে হাজি মুরাদের উপায় নেই। হাজি মুরাদ ভরন্তসভের কথার জবাব দিলেন, যেমন দিয়েছিলেন অন্য সবাইকে, তাদের সমাজে এমন কিছু হয় না। ভালো কি মন্দ, সে রকম কোনো মন্তব্য না করে।