তার নাম হাজি মুরাদ।
হাজি মুরাদ আত্মসমর্পণ করেছে, এখন শামিলও শেষ হয়ে যাবে, কারও মন্তব্য।
তারা এখন তা মনে করছে, এই এখন মানে ভরসভের অধীনে, তারা আর টিকে থাকতে পারবে না, আরেকজনের মন্তব্য।
সবই হয়েছে আপনার জন্য! ফরাসিতে বললেন মানানা ওরবেলিয়ানি।
প্রিন্স ভরন্তসভ তার দিকে আসা তোষামোদের ঢেউ কমাতে চেষ্টা করলেন। তা সত্ত্বেও সেগুলো ভালো লাগছিল এবং খুব উদ্দীপ্ত হয়ে তাকে আবার বসার ঘরে নিয়ে গেলেন।
রাতের খাবারের পর বসার ঘরে কফি পরিবেশন করা হলে প্রিন্স সবার প্রতি খুব বিনয়ী ছিলেন এবং গুফো জেনারেলের কাছে গেলে এমন ভাব দেখাতে চেষ্টা করলেন যে জেনারেলের বিরাট ভুলটি গোচরেই আসেনি।
সব অতিথিকে কফি দিয়ে তিনি তাসের টেবিলে বসলেন। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে খেলা অম্বে ছাড়া আর কিছু জানতেন না। প্রিন্সের সঙ্গে খেলছিলেন জর্জীয় প্রিন্স, একজন আর্মেনীয় জেনারেল (যিনি প্রিন্স ভরন্তসভের খানসামার কাছ থেকে খেলাটি শিখে নিয়েছেন) এবং চতুর্থজন ছিলেন ড. আন্দ্রিয়েভস্কি, প্রভাবশালী বলে যার অনেক সুনাম।
প্রিন্সের সোনার নস্যির কৌটাটির ঢাকনায় প্রথম আলেকজান্ডারের আবক্ষ প্রতিকৃতি খোদা, তিনি কৌটাটি পাশে রেখে খুব চকচকে একটি তাসের তোড়া খুলে বাটতে শুরু করলেন। ঠিক সেই সময় তার ইতালীয় খানসামা গিওভানি রুপোর ট্রেতে করে আরেকটি চিঠি এনে তাকে দিল।
আরেকজন দূত, মহাত্মন।
ভরন্তসভ তাসগুলো রেখে ক্ষমা চেয়ে চিঠিটি পড়তে শুরু করলেন।
চিঠিটি লিখেছিল তার ছেলে, হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণ ও মেলার জাকোমেলস্কির সঙ্গে তার কথোপকথনের বর্ণনা দিয়ে।
প্রিন্সেস এসে জানতে চাইলেন তাদের ছেলে কী লিখেছে।
সেই একই ঘটনা…(ফরাসি ভাষায়) সেখানকার অধিনায়কের সঙ্গে একটু কথা-কাটাকাটি হয়েছে। দোষ সিমোনের। তবে সব ভালো যার শেষ ভালো। চিঠিটি স্ত্রীর হাতে দিয়ে ইংরেজিতে তিনি শেষ করলেন। তারপর তার মেহমানদের দিকে ফিরে তিনি তাদের তাস টানতে বললেন।
প্রথম দফা বাটার পর, খোশমেজাজে থাকলে ভরন্তসভের যেমন অভ্যাস, তার সাদা কুঁচকে যাওয়া হাত দিয়ে ফরাসি নস্যির এক টিপ নাকের কাছে নিয়ে ভেতরে টানলেন।
১০. প্রিন্সের প্রাসাদে হাজির
১০
পরদিন হাজি মুরাদ প্রিন্সের প্রাসাদে হাজির হওয়ার আগেই দর্শনার্থীদের ঘরটি লোকজনে ভরে গিয়েছিল। সেখানে গতকালের গুফো জেনারেলও ছিলেন, বিদায় নিতে এসেছিলেন বলে তার পরনে ছিল সব কটি পদক লাগানো পুরো সামরিক পোশাক। উপস্থিত ছিলেন রসদের তহবিল তছরুপ করার অভিযোগে সামরিক আদালতে বিচারের ঝুঁকিতে থাকা একজন রেজিমেন্ট অধিনায়ক। (ড, আন্দ্রিয়েভস্কির সুপারিশে) একজন ধনী মার্কিন নাগরিক এসেছিল সরকারের কাছ থেকে ভোদকা বিক্রির একচেটিয়া অনুমতি নবায়নের আশায়। যুদ্ধে নিহত একজন সামরিক কর্মকর্তার বিধবা কালো পোশাক পরে এসেছিল। উদ্দেশ্য, ভাতা বা সন্তানদের বিনা খরচে লেখাপড়ার সুবিধা পাওয়া। জাঁকালো পোশাক পরা এক উচ্ছন্নে যাওয়া জর্জীয় প্রিন্স এসেছিলেন বাজেয়াপ্ত করা গির্জার সম্পত্তি বরাদ্দ নিতে। সেখানে একজন কর্মকর্তার হাতে বিশাল একটা গোটান কাগজে ককেশাসকে আয়ত্তে আনার একটি পরিকল্পনা ছিল। একজন খানও উপস্থিত ছিল, যার একমাত্র উদ্দেশ্য। প্রিন্সের সঙ্গে দেখা করেছে, প্রতিবেশীদের কাছে এই অহংকার করা।
সবাই যার যার পালার জন্য অপেক্ষা করছিল। সুন্দর চুলের একজন তরুণ এডিসি তাদের একজন একজন করে প্রিন্সের দপ্তরে ঢুকিয়ে আবার বের করে আনছিল।
হাজি মুরাদ চটপটেভাবে একটু খুঁড়িয়ে হেঁটে ঘরে ঢুকলে সবার চোখ পড়ল তার দিকে, সে শুনতে পেল ঘরের বিভিন্ন দিকে লোজন ফিসফিস করে তার নাম উচ্চারণ করছে।
তার পরনে ছিল কলারে সুন্দর কারুকাজ করা ফিতা লাগানো বাদামি বেশমেতের ওপর লম্বা সাদা চাপকান। কালো আঁটসাঁট পায়জামা এবং একই রঙের নরম জুতা, পায়ের পাতার সঙ্গে তা দস্তানার মতো লেগেছিল। তার মাথায় ছিল পাগড়িঘেরা লম্বা টুপি, প্রকাশ্যে আহমেদ খানের বিরোধিতা করার জন্য জেনারেল ক্রুগানু তাকে গ্রেপ্তার করার সময় ঠিক এই পাগড়িটাই তার মাথায় ছিল। ওই গ্রেপ্তারের কারণ তিনি শামিলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।
হাজি মুরাদ দর্শনার্থীদের ঘরের নকশাকাটা কাঠের মেঝেয় চটপটেভাবে হেঁটে ঢুকেছিলেন। একটা পা খাটো থাকায় খুঁড়িয়ে হাঁটার জন্য তার ঋজু শরীর সামান্য দুলছিল। শান্তভাবে তাকানো চোখ দুটি যেন কাউকে দেখছিল না।
সুদর্শন এডিসি তাকে স্বাগত জানিয়ে প্রিন্সের কাছে তার আগমনের খবর দেওয়ার আগে একটু বসতে অনুরোধ করল। কিন্তু হাজি মুরাদ বসতে চাইলেন না এবং ছোরার ওপর হাত রেখে উপস্থিত সবার দিকে তাচ্ছিল্যভরে তাকালেন।
প্রিন্সের দোভাষী প্রিন্স তারখানভ হাজি মুরাদের কাছে এসে তার সঙ্গে কী বলল। হাজি মুরাদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সংক্ষেপে জবাব দিল। একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে আসা এক কুমিক প্রিন্স কামরা থেকে বের হয়ে এলে এডিসি হাজি মুরাদকে দরজার কাছে নিয়ে ভেতরে যাওয়ার ইশারা করল।
তার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে ভরন্তসভ হাজি মুরাদকে স্বাগত জানালেন। প্রধান সেনাপতির সাদা মুখে গতকালের মতো স্মিত হাসি ছিল না, বরং মুখটা ছিল কঠিন ও গম্ভীর।