একাধিকবার, প্রিন্সেস।
এবং জেনারেল বলতে শুরু করলেন, ১৮৪৩ সালে পাহাড়িরা গাৰ্গবিল দখল করে নিলে হাজি মুরাদ জেনারেল পাসেকের বাহিনীর ওপর হামলা করেন এবং প্রায় তাদের চোখের সামনেই কর্নেল জোলোতুখিনকে হত্যা করেন।
তার কথা শুনে জেনারেল আলোচনায় যোগ দেওয়ায় খুশি হয়ে ভরন্তসভ বিনয়ীভাবে মুচকি হাসলেন। কিন্তু হঠাৎ ভরসভের চেহারায় অমনোযোগ ও বিষাদের ছাপ পড়ল।
জেনারেল না থেমে বলতে থাকলেন হাজু মুরাদের সঙ্গে তার দ্বিতীয় সাক্ষাতের কথা।
কেন, আপনার কি মনে নেই, এ হচ্ছে সেই লোক, যে বিস্কিট অভিযানে উদ্ধার দলের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েছিল।
জেনারেল যে উদ্ধার দলের কথা বলছিলেন, সেটা ছিল দারগো অভিযানের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, যখন সেনাপতি ভরন্তসভসহ সব সৈন্য অবশ্যই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত যদি সৈন্য বৃদ্ধি করে তাদের উদ্ধার করা না হতো। সবাই জানত ভরন্তসভের অধীনে দারগো অভিযান একটি লজ্জাজনক ঘটনা। কারণ, রাশিয়া তাতে হেরে যায়, অনেক নিহত ও আহত হয় এবং বেশ কিছু কামান খোয়াতে হয়। তাই কেউ ভরসভের উপস্থিতিতে ওই ঘটনার উল্লেখ করলে ভরন্তসভ জারের কাছে সেটাকে রুশ সেনাবাহিনীর চমৎকার সাফল্য উল্লেখ করে যেভাবে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, সেটাই বলেন। কিন্তু উদ্ধার শব্দটি সোজাসুজি বুঝিয়ে দেয় যে ঘটনাটা চমঙ্কার বিজয় ছিল না, বরং বহু জীবননাশী মারাত্মক ভুল ছিল। সবাই তা বুঝেছিল, তাই কেউ কেউ জেনারেলের কথার অর্থ না বোঝার ভান করল, অন্যরা ঘাবড়ে গিয়ে এরপর কী ঘটে দেখার অপেক্ষায় ছিল, কেউ কেউ ইশারা বিনিময় করে মিটিমিটি হাসছিল। কেবল গাজরবর্ণ গুফো জেনারেল কিছুই বুঝতে পারছিলেন না এবং তার বর্ণনা চালিয়ে যেতে থাকলেন, উদ্ধার অভিযানে, মহাত্মন।
তার প্রিয় বিষয়টি শুরু করতে পেরে জেনারেল প্রতিমুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে চললেন হাজি মুরাদ কী করে ধূর্তভাবে রুশ সেনাদলকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেন, যাতে উদ্ধার দল (মনে হচ্ছিল উদ্ধার শব্দটি তার খুব প্রিয়) না গেলে রুশ বাহিনীর একটা লোকও পালাতে পারত না, কারণ…জেনারেল তার কথা শেষ করতে পারলেন না। কারণ, কী ঘটছে বুঝতে পেরে মানান ওরবেলিয়ানি তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে তিনি তিবলিসে থাকার ভালো জায়গা পেয়েছেন কি না। বিস্মিত হয়ে জেনারেল চারদিকে সবার দিকে তাকালেন এবং দেখলেন টেবিলের শেষ প্রান্তে তার এডিসি তার দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে স্থির তাকিয়ে আছে। তখনই তিনি বুঝতে পারলেন। প্রিন্সেসের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি ভুরু কুঁচকে থেমে গেলেন। তারপর তার প্লেটে যেসব সুস্বাদু খাবার দেওয়া হয়েছিল, তা না চিবিয়েই গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলেন। খাবারগুলোর স্বাদ-গন্ধ-রূপ সৰ তার কাছে রহস্যময় লাগল।
সবাই অস্বস্তিবোধ করছিল, সেই অবস্থা কাটিয়ে দিলেন জর্জীয় প্রিন্স–একটা বেকুব কিন্তু চতুর তোষামুদে। তিনি বসে ছিলেন প্রিন্সেস ভরসভের অন্য পাশে। কী ঘটছে, তা যেন বুঝতে পারেননি, এমনভাবে তিনি বলতে শুরু করলেন হাজি মুরাদ কেমন করে মেহকুলের আহমেদ খানের বিধবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সে রাতে গ্রামে এসে যা নিতে চেয়েছিল, নিয়ে পুরো দলসহ ফিরে যায়।
কেন সে এই বিশেষ মহিলাকে নিয়েছিল? প্রিন্সেস জিজ্ঞেস করলেন।
ওহ, সে মহিলার স্বামীর শত্রু ছিল, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার পেছনে ধাওয়া করে ধরতে পারেনি, তাই তার স্ত্রীর ওপর প্রতিশোধ নিয়েছিল।
প্রিন্সেস জর্জীয় প্রিন্সের পাশে বসা তার পুরোনো বান্ধবী কাউন্টেস শোয়াসোইকে কথাগুলো ফরাসিতে বুঝিয়ে দিলেন।
কী ভয়ানক! কাউন্টেস ফরাসিতে বললেন।
ওহ, না! মৃদু হেসে বললেন ভরন্তসভ। আমি শুনেছি সে বীরের মতোই তার বন্দীকে সম্মান করেছিল এবং পরে মুক্তি দিয়েছিল।
হ্যাঁ, মুক্তিপণের বিনিময়ে।
হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু একই কথা, সে সম্মানজনক ব্যবহার করেছিল।
প্রিন্সের কথাগুলো আলোচনার খেই ধরিয়ে দিয়েছিল। আমন্ত্রিতরা বুঝতে পেরেছিলেন, হাজি মুরাদকে যত গুরুত্ব দেওয়া হবে, প্রিন্স ততই খুশি হবেন।
লোকটির অবাধ্যতা মুগ্ধকর। একজন উল্লেখযোগ্য মানুষ!
কেন, ১৮৪৯ সালে সে তেমির-খান-শুরায় প্রকাশ্য দিনের বেলা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল।
তখন তেমির-খান-শুরায় উপস্থিত ছিলেন, টেবিলের শেষ দিকে বসা এমন একজন আর্মেনীয় হাজি মুরাদের সেই লুটের কথা বিস্তারিত বললেন।
আসলে খাওয়ার সময়ের পুরোটা জুড়েই হাজি মুরাদের কথা আলোচনা হচ্ছিল।
প্রত্যেকে একের পর এক হাজি মুরাদের সাহস, যোগ্যতা ও মহানুভবতার কথা বলছিলেন। কেউ একজন তার ২৬ জন বন্দীকে জবাইয়ের আদেশ দেওয়ার কথা বললেন; কিন্তু স্বভাবতই সেটারও বিরোধিতা হলো।
কী করা যেত? যুদ্ধ যুদ্ধই (ফরাসি প্রবাদ)!
সে মহান লোক।
যদি ইউরোপে তার জন্ম হতো, তাহলে সে হয়তো আরেকজন নেপোলিয়ন হতো, বললেন বেকুব তোষামোদের গুণধর জর্জীয় প্রিন্স।
তিনি জানতেন, নেপোলিয়নের নাম উচ্চারণ ভরসভের কাছে মধুর, নেপোলিয়নকে হারিয়েই তিনি পুরস্কার হিসেবে তার গলায় পরা হোয়াইট ক্রসটি পেয়েছেন।
ঠিক নেপোলিয়ন নয়, যদি বলেন, সম্ভবত ঘোড়সওয়ার দলের বীর হতে পারত, বললেন ভরন্তসভ।
নেপোলিয়ন, না হলে মুরাদ।