পিটারের বিধবা আকসিনিয়া মাত্র এক বছর একসঙ্গে থাকা প্রিয়তম স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে হাউমাউ করে বিলাপ করল। স্বামীর জন্য এবং তার নিজের ছারখার হয়ে যাওয়া জীবনের জন্য দুঃখ করল; বিলাপের মধ্যে সে পিটারের কোঁকড়া কালো চুল এবং তার ভালোবাসার কথা, ছোট্ট এতিম আইভানকে নিয়ে তার দুঃখময় জীবনের কথা মনে করছিল; অচেনা পৃথিবীতে ঠেলে দেওয়া হতভাগ্য বউটির দিকে না দেখিয়ে ভাইয়ের প্রতি দয়া দেখানোর জন্য পিটারকে বকল!
আকসিনিয়া অবশ্য মনে মনে স্বামীর মৃত্যুতে খুশি হয়েছিল। সে যে দোকানে কাজ করত, তার মালিকের মাধ্যমে সে আবার গর্ভবতী হয়েছিল; এখন কেউ আর তাকে খোটা দিতে পারবে না, দোকানমালিক তাকে বিয়েও করতে পারে, তাকে পটানোর জন্য দোকানমালিকটি তা-ই বলেছিল।
৯
মিখাইল সেমিয়ানোভিচ ভরন্তসভ রুশ রাষ্ট্রদূতের ছেলে হওয়ায় ইংল্যান্ডে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং তার সমসাময়িক উচ্চপদস্থ রুশ কর্মকর্তাদের থেকে ব্যতিক্রমী ইউরোপীয় শিক্ষা পেয়েছিলেন। তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ভদ্র, অধস্তনদের প্রতি দয়ালু এবং উচ্চপদস্থদের অনুগ্রহ পেতে আগ্রহী ছিলেন। ক্ষমতা ও বশ্যতা ছাড়া জীবন কী, তা তিনি জানতেন না। সব পদ ও পুরস্কার। পেয়েছিলেন, ক্রাসনির যুদ্ধে নেপোলিয়নকে পরাজিত করায় তাকে একজন মেধাবী অধিনায়ক মনে করা হতো।
১৮৫১ সালে তার বয়স ছিল সত্তরের বেশি কিন্তু তিনি বেশ সতেজ, চটপটে ছিলেন, তার ওপর সাবলীল, পরিশীলিত ও অমায়িক বিচারবুদ্ধি পুরোপুরি ধরে রেখেছিলেন। এসব গুণ তিনি ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য কাজে লাগাতেন। তার ধন-সম্পদ ছিল প্রচুর, তার নিজের এবং তার স্ত্রীর (জন্মের পর তার নাম ছিল কাউন্টেস ব্রানিস্কি), এবং ভাইসরয় হিসেবে পেতেন বিশাল অঙ্কের বেতন। তিনি সম্পদের একটা বড় অংশ ক্রাইমিয়ার দক্ষিণ কূলে একটা প্রাসাদ এবং বাগান বানাতে খরচ করেন।
৭ ডিসেম্বর ১৮৫১ সাল। সন্ধ্যায় তিবলিসে তার প্রাসাদের সামনে একটা তিন ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল। ধুলায় ধূসর ক্লান্ত একজন কর্মকর্তা গাড়ি থেকে নেমে পায়ের জমে যাওয়া পেশিগুলো টান করে সান্ত্রিদের পার হয়ে চওড়া গাড়িবারান্দায় ঢুকল। জেনারেল কজলভস্কি তাকে হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণের খবর দিয়ে পাঠিয়েছেন। তখন সন্ধ্যা ছয়টা এবং ভরসভ রাতের খাবারের জন্য যাচ্ছিলেন, সে সময় তাকে দূত আসার খবর দেওয়া হয়। ভরন্তসভ তার সঙ্গে দেখা করেন আর তাই ডিনারে যেতে কয়েক মিনিট দেরি হয়।
তিনি যখন বসার ঘরে ঢুকলেন, আমন্ত্রিত ৩০ জন অতিথির কেউ কেউ প্রিন্সেস এলিজাবেথ কাসাভিয়েরেভনা ভরসভের পাশে বসে ছিলেন বা ঘোট ছোট দলে জানালাগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। তারা সবাই প্রিন্সের দিকে তাকালেন। ভরন্তসভ পড়েছিলেন নিয়মিত ব্যবহারের কালো সামরিক কোট, তবে কাঁধে পদমর্যাদার বিহ্ন ছিল না। গলায় ছিল সর্বোচ্চ সামরিক পদক অর্ডার অব সেন্ট জর্জের হোয়াইট ক্রস।
পরিষ্কার করে কামানো লম্বাটে মুখে স্মিত হাসি ধরে তিনি ভুরু কুঁচকে অতিথিদের একবার দেখলেন। দ্রুত হালকা পায়ে ঢুকে দেরি করার জন্য প্রথমেই ক্ষমা চাইলেন মহিলাদের কাছে, পুরুষদের স্বাগত জানালেন। তারপর লম্বা, আনুমানিক ৪৫, প্রাচ্য ধাঁচের সুন্দরী প্রিন্সেস মানানা ওরবেলিয়ানির দিকে এগিয়ে গিয়ে বাহু বাড়িয়ে নৈশভোজে যোগ দেওয়ার অনুরোধ করলেন। প্রিন্সেস কাসাভিয়েরেভনা ভরন্তসভ তার বাহু বাড়িয়ে দিলেন তিবলিস ভ্রমণে আসা একজন লালচুল খোঁচা-গোঁফ জেনারেলের দিকে। একজন জর্জীয় প্রিন্স তার বাহু বাড়ালেন প্রিন্সেস ভরসভের বান্ধবী কাউন্টেস শোয়াসোইয়ের দিকে; এডিসি ড, আন্দ্রিয়েভস্কি এবং অন্যরা মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে বা একাই সামনের যুগলদের অনুসরণ করলেন। উর্দি এবং হাঁটু অব্দি আঁটো পায়জামা পরা খানসামারা চেয়ার পিছে টেনে এবং আবার সামনে ঠেলে দিয়ে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা করে দিল। প্রধান খানসামা রুপার পাত্র থেকে বড় হাতা দিয়ে নম্রভাবে পেয়ালায় স্যুপ ঢেলে দিল।
লম্বা টেবিলের ঠিক মাঝখানে ভরন্তসভ বসে ছিলেন, তার স্ত্রী বসে ছিলেন উল্টো দিকে, জেনারেলকে ডান দিকে নিয়ে। প্রিন্সের ডান দিকে বসে ছিলেন। সুন্দরী ওরবেলিয়ানি; আর বাঁ দিকে ছিলেন কালোচুল, গোলাপি চাপার মতো রঙের কমনীয় এক জর্জীয় মহিলা। ঝকমকে অলংকারের মধ্য থেকে তিনি হেসেই চলছিলেন।
বার্তাবাহক কী খবর নিয়ে এসেছে, তার স্ত্রীর প্রশ্নে ফরাসিতে জবাব দিলেন ভরন্তসভ, চমৎকার, প্রিয়তমা। সিমমানের সৌভাগ্য! তিনি জোরে বলতে শুরু করলেন, যাতে সবাই শুনতে পায়। দারুণ খবর (যদিও তার জন্য অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ, অনেক দিন ধরেই কথাবার্তা চলছিল) যে শামিলের সেনাপতিদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী এবং বিখ্যাত হাজি মুরাদ রুশদের পক্ষে চলে এসেছেন, দু-এক দিনের মধ্যেই তাকে তিবলিসে আনা হবে।
টেবিলের শেষ দিকে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প ও হাসিঠাট্টায় ব্যস্ত তরুণ এডিসি, অফিসাররাসহ প্রত্যেকে চুপ করে শুনতে লাগল।
জেনারেল, আপনি কি কখনো হাজি মুরাদকে দেখেছেন! প্রিন্সের কথা শেষ হলে প্রিন্সেস তার পাশে বসা গাজরবর্ণ গুফো জেনারেলকে জিজ্ঞেস করলেন।