অনেক হয়েছে, বাবা, আঁটি বাঁধার খড়গুলো সরাতে সরাতে বলল ছেলের বউ।
হ্যাঁ, তোমাদের ছয়টাকে খাওয়াই আর একজনের কাজও পাই না! পিটার দুজনের সমান কাজ করত। সে এ রকম ছিল না।
পায়ে চলা পথ ধরে বাড়ি থেকে এল বুড়োর স্ত্রী। তার শক্ত করে পশমি ফিতে জড়ানো পায়ে নতুন গাছের বাকলের জুতা। তার নিচে জমাট বরফ মচমচ করে ভাঙছিল। পুরুষেরা কাঠের কোদাল দিয়ে আঝাড়া যুবগুলো এক জায়গায় জড়ো করছিল। যেগুলো পড়েছিল, ছেলের বউ আর মেয়ে তা ঝাড়ু দিচ্ছিল।
গ্রামের মুরব্বিদের পাঠিয়েছিল, সবাইকে ইট টানতে মালিকের বাড়িতে যেতে বলেছে, বুড়ি বলল। আমি নাশতা বানিয়ে রেখেছি…তোমরা খেতে আসবে না?
ঠিক আছে। যা, পাতলা গদিটা লাগিয়ে যা। আকিমকে বলল বুড়ো, দেখিস, আমাকে আবার সেদিনের মতো বিপদে ফেলিস না! পিটারের জন্য দুঃখ না করে পারা যায় না!
সে যখন বাড়িতে ছিল, তখন তুমি তাকে বকাবকি করতে, পাল্টা জবাব দিল আকিম। এখন সে নাই আর তুমি আমার সঙ্গে ঘ্যান ঘ্যান করো।
এতেই বোঝা যায় এটা তোর পাওনা, তার মা একই রকম রাগত সুরে বলল। তুই কখনো পিটারের সমান হবি না।
আচ্ছা, ঠিক আছে, ছেলে বলল।
ঠিক আছে, আসলেই! গম বেচে মদ গিলেছ, এখন তুমি বলছ ঠিক আছে!
যা গেছে যেতে দিন না! ছেলের বউ বলল।
বাবা ও ছেলের এই ঝগড়া বহুদিনের, প্রায় পিটার সেনাবাহিনীতে যাওয়ার পর থেকে। তখন থেকেই বুড়ো মনে করত সে নাকের বদলে নরুন পেয়েছে। বুড়ো বুঝত একজন পিতার চেয়ে একজন সন্তানহীনের যাওয়াই ঠিক। আকিমের চার সন্তান ছিল, পিটারের একজনও না; কিন্তু পিটার তার বাবার মতো দক্ষ, বিচক্ষণ, সবল, ধৈর্যবান এবং সর্বোপরি পরিশ্রমী ছিল। সে সব সময় কাজ করত। কোথাও যাওয়ার সময় সে যদি দেখত লোকে কাজ করছে, তবে সে থেমে তাদের সাহায্য করত, যেমন তার বাবাও করত, হয় দু-এক বোঝা খড় কেটে দিত বা গাড়ি বোঝাই করে দিত বা গাছ কেটে দিত বা কাঠ ফেড়ে দিত। সে চলে যাওয়ায় বুড়ো খুব দুঃখ করত, কিন্তু তার কোনো প্রতিকার ছিল না। সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নাম লেখানো তখনকার দিনে মরে যাওয়ার মতো ছিল। একজন সৈন্য যেন গাছের কাটা ডাল; বাড়িতে তার জন্য দুঃখ করা ছিল কারও বুক অকারণে ছিঁড়ে ফেলার মতো। শুধু মাঝেমধ্যে বড় ছেলেকে খোঁচানোর জন্য বাবা এই কথা বলত, সেদিন সে যেমন বলেছিল। কিন্তু তার মা প্রায়ই ছোট ছেলের কথা মনে করত এবং সে অনেক দিন ধরে, প্রায় এক বছর ধরে তার স্বামীকে বলছিল পিটারকে কিছু টাকা পাঠাতে, বুড়ো তার কোনো জবাব দেয়নি।
আভদিয়েভদের পরিবার সচ্ছল ছিল এবং বুড়ো কিছু টাকা গোপনে জমিয়ে রেখেছিল কিন্তু সে কিছুতেই সরিয়ে রাখা টাকায় হাত দিত না। এখন সে ছোট ছেলের কথা বলছে শুনে তার বুড়ি স্ত্রী ঠিক করল, তাকে যব বেচে অন্তত এক রুবল পাঠানোর কথা আবার বলবে। সে তা-ই করল। অন্যরা মালিকের কাজ করার জন্য চলে যাওয়ার পরই তারা একা হয়ে গেলে, সে বুড়োকে যব বেচা টাকা থেকে পিটারকে এক রুবল পাঠাতে রাজি করাল।
তাই তিনটি টানা গাড়িতে ছিয়ানব্বই বুশেল (এক বুশেল–আট গ্যালন) বস্তার ঘেরে কাঠের আংটা দিয়ে সাবধানে বাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করা হলে বুড়ি বুড়োর হাতে একটা চিঠি দিল। গির্জার কেরানি বুড়ির কথামতো লিখে দিয়েছে। বুড়ো কথা দিল, শহরে গিয়ে সে এক রুবল ভরে সঠিক ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে।
বুড়ো ভেড়ার চামড়ার একটি নতুন কাপড় পরে তার ওপর বাড়িতে বানানো চাদর পরল এবং পায়ে সাদা পশমি ফিতে পেঁচাল, চিঠিটি নিয়ে তার ছোট ব্যাগে ভরল, তারপর দোয়া পড়ে সামনের গাড়িটিতে উঠে শহরে রওনা হলো। তার নাতি বসল পেছনের গাড়িটায়। শহরে পৌঁছে সে সরাইয়ের লোকটাকে চিঠিটা দিল তাকে পড়ে শোনানোর জন্য। সে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল এবং তাতে সায় দিল।
চিঠিতে পিটারের মা প্রথমে তাকে দোয়া করেছিল, তারপর সবার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা এবং তার দাদার মৃত্যুর খবর লেখা ছিল এবং তারপর লেখা ছিল আকসিনিয়া (পিটারের স্ত্রী) তাদের সঙ্গে থাকতে চায়নি, সে চাকরি করছে এবং তারা শুনেছে যে সে সুন্দর, সৎ জীবন কাটাচ্ছে। তারপর রুবল পাঠানোর কথা। সবশেষে তার নিজের কথাগুলো। সে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে যা বলেছে, গির্জার কেরানি ঠিক সেই শব্দগুলোই হুবহু লিখে দিয়েছে–
আরেকটা কথা, আমার প্রিয় বাছা, আমার মিষ্টি পায়রা, আমার নিজের পিটারকিন! আমি তোমার কথা মনে করে সব সময় চোখের পানি ফেলি, আমার চোখের আলো। তুমি আমাকে কোথায় রেখে গেছ? এই সময় বুড়ি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, এতেই চলবে! চিঠিতে শব্দগুলো ঠিক এইভাবে ছিল। কিন্তু ভাগ্যে লেখা ছিল না যে পিটার তার স্ত্রীর বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা বা রুবল পাঠানোর কথা বা মায়ের শেষ কথাগুলো জানতে পারবে। চিঠিটা পাঠানো টাকাসহ ফেরত আসে এবং জানানো হয় পিটার তার জারকে, তার পিতৃভূমিকে এবং অর্থোডক্স ধর্মমতকে রক্ষার যুদ্ধে মারা গেছে। সেনাবাহিনীর কেরানি এভাবেই লিখেছিল।
এই খবর পৌঁছানোর পর বুড়ি যতক্ষণ সময় করতে পারল কাঁদল, তারপর কাজে লেগে গেল। ঠিক পরের রোববার সে গির্জায় গিয়ে একটি প্রার্থনাসংগীত গাইল এবং যাদের জন্য প্রার্থনা করা হয়, তাদের নাম উচ্চারণের জায়গায় সে পিটারের নাম বলল; তারপর সে ঈশ্বরের ভৃত্য পিটারের নামে সব ভালো মানুষের মধ্যে পবিত্র রুটি বিতরণ করল।