তার বন্ধু পানভ ও সেরোগিন এসেছে। কিন্তু আভদিয়ে শুয়ে থাকল একইভাবে, সামনের দিকে তাকিয়ে। তার বন্ধুদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকার অনেকক্ষণ পর সে সহকর্মীদের চিনতে পারল।
পিটার, তোমার বাড়িতে কি খবর দেওয়া দরকার? পানভ জিজ্ঞেস করল।
আভদিয়েভ পানভের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও জবাব দিল না।
তোমার বাড়িতে কি কিছু বলে পাঠাতে হবে? আভদিয়েভের মোটা হাড়ের ঠান্ডা হাত ছুঁয়ে আবার জিজ্ঞেস করল পানভ।
আভদিয়েভের যেন হুঁশ ফিরে এল।
ও! পানভ!
হ্যাঁ, দেখো, আমি এসেছি! তোমার বাড়িতে খবর পাঠাতে হবে না? সেরোগিন একটা চিঠি লিখে দেবে।
সেরোগিন… কষ্ট করে সেরোগিনের দিকে চোখ ফিরিয়ে আভদিয়েভ বলল, তুমি কি লিখে দেবে?…তাহলে লিখো, তোমার ছেলে পিটার তোমাদের অনেক দিন বেঁচে থাকতে বলেছে (প্রচলিত এই কথার অর্থ চিঠির লেখক মারা গেছে)। সে তার ভাইকে হিংসা করে…আমি আজকেই তোমাদের এ কথা বলেছি…সে এখন খুশি হবে। তাকে বিরক্ত কোরো না। তাকে বাঁচতে দাও। ঈশ্বর তাকে বাঁচিয়ে রাখুক। আমি খুশি! এই লিখে দাও।
এ কথা বলে পানভের দিকে তাকিয়ে সে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।
হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি তোমার পাইপটা পেয়েছ? পানভ জবাব দিল না।
তোমার পাইপ…তোমার পাইপ! জিজ্ঞেস করছি ওটা পেয়েছ? আভদিয়েভ আবার বলল।
ওটা আমার ব্যাগে ছিল।
ঠিক আছে!…বেশ, এখন আমাকে একটা মোমবাতি এনে দাও…আমি মরতে যাচ্ছি, বলল আভদিয়েভ।
ঠিক তখনই পোলতোরাৎস্কি তার সৈন্যকে দেখার জন্য ভেতরে ঢুকল।
কেমন আছ, ব্যাটা! খারাপ? সে জিজ্ঞেস করল।
না, আভদিয়ে চোখ বুজে মাথা নেড়ে জানাল। তার চোয়াল মোটা মুখটা ছিল ফ্যাকাশে আর কঠোর। সে জবাব দিল না কিন্তু আবার পানভকে বলল, একটা মোমবাতি আনো,..আমি মারা যাচ্ছি।
একটা মোমবাতি এনে তার হাতে দেওয়া হলো কিন্তু তার আঙুলগুলো বাঁকানো যাচ্ছে না বলে বাতিটাকে আঙুলের মধ্যেই গুঁজে দিয়ে তার জন্য উঁচু করে ধরা হলো।
পোলতোরাৎস্কি চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর আরদালি আভদিয়েভের হৃৎস্পন্দন শোনার চেষ্টা করল বুকে কান পেতে, বলল, সব শেষ।
আভদিয়েভের মৃত্যুর বিবরণ যেভাবে তিবলিসে পাঠানো হয়, তা নিচে দেওয়া হলো।
২৩ নভ। কুরিল রেজিমেন্টের দুটো কোম্পানি দুর্গ থেকে বের হয়ে গাছ কাটার অভিযানে যায়। দুপুরের দিকে অনেক পাহাড়ি গাছ কাটিয়েদের ওপর হঠাৎ হামলা করে। অব্যর্থ লক্ষ্যভেদীরা পিছু হটতে শুরু করে কিন্তু দ্বিতীয় কোম্পানি বেয়নেট দিয়ে আক্রমণ করে পাহাড়িদের হটিয়ে দেয়। এই ঘটনায় দুজন সৈন্য সামান্য আহত হয় এবং একজন নিহত হয়। পাহাড়িদের প্রায় ১০০ জন হতাহত হয়েছে।
৮
ভজভিঝেনস্কের হাসপাতালে পিটার আভদিয়েভ মারা যাওয়ার দিন তার বৃদ্ধ বাবা, যে ভাইয়ের বদলে সে সামরিক বাহিনীতে তালিকাভুক্ত হয়েছিল, তার স্ত্রী এবং সেই ভাইয়ের মেয়ে শক্ত বরফশীতল মাড়াইয়ের জায়গায় যব মাড়াই করছিল। ভাইয়ের মেয়েটা ঋতুমতী এবং বিয়ের যোগ্য হয়েছে।
তার আগের দিন ভারী তুষার পড়েছে এবং সকালের দিকে তা জমে বরফ হয়ে যায়। মোরগগুলো তৃতীয়বার ডাকলে বুড়ো জেগে যায় এবং বরফঢাকা জানালা দিয়ে উজ্জ্বল চাঁদের আলো দেখে চুল্লির ওপর থেকে নেমে আসে, তার জায়গায় যায়। ঘণ্টা দুয়েক সেখানে কাজ করার পর সে কুঁড়ের মধ্যে ফিরে এসে তার ছেলে ও মহিলাদের জাগায়। ছেলের বউ ও মেয়েটা মাড়াইয়ের জায়গায় গিয়ে দেখে তা ঝেড়ে পরিষ্কার করা এবং একটা কাঠের কোদালে সাদা শুকনা বরফে আটকে আছে, তার পাশে কাঠির আঁটাগুলোর শলা ওপরের দিক করে দাঁড়ানো। দুই সারি যবের আটি শিষগুলো মুখোমুখি করে পরিষ্কার করা মাড়াইয়ের জায়গাজুড়ে রাখা। তারা তাদের মাড়াইয়ের লাঠি বেছে নিয়ে তিনজন তালে তালে মাড়াই শুরু করে দিল। বুড়ো তার ভারী লাঠিটি দিয়ে খড়গুলো ভেঙে ফেলছিল; মেয়েটা শিষগুলোকে মাপা হাতে পেটাচ্ছিল আর ছেলের বউ তার লাঠি দিয়ে যুবগুলো উল্টে দিচ্ছিল।
চাঁদ ডুবে গিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছিল এবং তারা তাদের সারি প্রায় শেষ করে আনার সময় মাড়াইকারীদের সঙ্গে যোগ দিল বুড়োর বড় ছেলে আকিম।
তাকে দেখে কাজ থামিয়ে বুড়ো তার মাড়াইয়ের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, তুই অলসের মতো কী করছিলি?
ঘোড়াগুলোকেও দেখতে হয়েছে।
ঘোড়াগুলো দেখতে হয়েছে! ছেলেকে ভেঙিয়ে বলল বাবা। ওগুলো বুড়ি দেখবে। তোর মাড়াইয়ের লাঠি নে! ভোটকা হয়েছিস, ব্যাটা মাতাল!
তুমি আমাকে মদ দিয়েছিলে? বিড়বিড় করে বলল ছেলে। কী? একটা বাড়ি বন্ধ করে কড়া দৃষ্টিতে বলল বুড়ো। ছেলে নীরবে একটা লাঠি তুলে নিলে তারা চারটা লাঠি দিয়ে মাড়ানো শুরু করল।
ত্রাক, টপটম…ত্রাক, টপটম ব্রাক… বুড়োর ভারী লাঠির বাড়ি পড়ছে বাকি তিনজনের ওপরে।
তোর গর্দান এ রকম ভদ্রলোকের মতো হয়েছে কেন! এই দেখ আমার ট্রাউজার ঝুলে থাকার জন্য কিছু কোমরে কিছু নেই! বাড়ি না দিয়ে শুধু তাল রাখার জন্য শূন্যে লাঠিটা ঘুরিয়ে বলল বুড়ো।
তাদের সারি শেষ হয়ে গেলে মেয়েরা আঁচড়া দিয়ে খড়গুলো সরাতে শুরু করল।
তোর বদলে পিটার গিয়ে বোকামি করেছে। সেনাবাহিনী তোর বলদামি ছুটিয়ে দিত; বাড়িতে সে তোর পাঁচটার সমান হতো!