তার পড়ার ঘরের দরজা খুলে প্রিন্স ভরন্তসভকে ভেতরে ঢোকার অনুরোধ করলেন এবং প্রিন্সকে তার আগে যেতে দিলেন।
পড়ার ঘরে ঢুকে তিনি প্রিন্সের সামনে থেমে তাকে বসতে না দিয়েই বললেন, এখানে আমি অধিনায়ক, তাই শত্রুর সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা অবশ্যই আমার মাধ্যমে করতে হবে! তুমি কেন আমাকে হাজি মুরাদের আসার কথা জানাওনি?
একজন দূত এসে আমাকে বলেছিল, হাজি মুরাদ কেবল আমার কাছে ধরা দিতে চায়, উত্তেজনায় ফ্যাকাশে হয়ে রাগত জেনারেলের কাছ থেকে রূঢ় জবাব আসবে ভেবে নিজেও রেগে জবাব দিলেন ভরসভ।
আমি জিজ্ঞেস করছি আমাকে কেন জানানো হয়নি?
আমি তা করতে চেয়েছিলাম, ব্যারন, কিন্তু…।
তুমি আমাকে ব্যারন বলবে না, স্যার বলবে! সেই মুহূর্তে ব্যারনের রাগ হঠাৎ ফেটে পড়ল এবং দীর্ঘদিন ধরে তার মনে যত রাগ জমা হয়ে ফুটছিল, তা সব বের হতে থাকল।
আমি সাতাশ বছর জারের চাকরি এই জন্য করিনি যে পরিবারের সুপারিশে গতকাল চাকরিতে যোগ দিয়ে কেউ আমার নাকের নিচে এমন সব আদেশ দিতে থাকবে, যেগুলো তাদের কোনো কাজ নয়!
বাধা দিয়ে ভরন্তসভ বললেন, স্যার, আমি আপনাকে অসত্য কিছু না বলার অনুরোধ করছি।
আমি সত্য কথাই বলছি, আমি সহ্য করব না… জেনারেল আরও রেগে বললেন।
সেই মুহূর্তে স্কার্টে খসখস শব্দ তুলে মারিয়া ভাসিলিয়েভনা ঘরে ঢুকল, তার পেছনে পেছনে একজন ছোটখাটো ভদ্র মহিলা, মেলার-জাকোমেলস্কির স্ত্রী।
শোনো, শোনো ব্যারন! সাইমন তোমাকে অসন্তুষ্ট করতে চায়নি, মারিয়া ভাসিলিয়েভনা বলতে শুরু করলেন।
আমি সে কথা বলছি না, প্রিন্সেস…।
ঠিক আছে, এগুলো সব বাদ দাও! তুমি জানো, খারাপ শান্তি ভালো ঝগড়ার চেয়ে ভালো!…হায় খোদা, আমি কী বলছি? এবং সে হাসতে শুরু করল।
ক্রুদ্ধ জেনারেল সুন্দরীর হাসিতে ধরা পড়লেন। তার গোঁফের নিচে ভেসে উঠল মুচকি হাসি।
স্বীকার করি আমি ভুল করেছি, বললেন ভরন্তসভ, কিন্তু…
আমিও একটু খেপে গিয়েছিলাম, বললেন মেলার এবং প্রিন্সের দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিলেন।
শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। ঠিক হলো হাজি মুরাদকে তখনকার মতো মেলারের কাছেই রাখা হবে এবং পরে তাকে লেফট-ফ্ল্যাঙ্কের অধিনায়কের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
হাজি মুরাদ বসে ছিলেন পাশের ঘরে এবং কী বলা হচ্ছিল, বুঝতে না পারলেও যা বোঝা দরকার, তা ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন। যেমন ঝগড়া হচ্ছিল তাকে নিয়েই এবং তার শামিলকে ছেড়ে আসাটা রুশদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাই তারা তাকে মারবে না বা নির্বাসনে পাঠাবে না, বরং সে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আদায় করে নিতে পারবে। তিনি আরও বুঝেছিলেন, মেলার-জাকোমেলস্কি অধিনায়ক হলেও অধীনস্থ ভরন্তসভের মতো প্রভাব তার নেই। ভরন্তসভ গুরুত্বপূর্ণ আর মেলার-জাকোমেলস্কি গুরুত্বহীন এবং তাই মেলার-জাকোমেলস্কি তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে হাজি মুরাদ দৃপ্ত ও জমকালো ভাষায় বললেন, তিনি শ্বেতাঙ্গ জারের সেবা করতে এসেছেন এবং কেবল তার সরদারের কাছেই জবাব দেবেন। তার সরদার বলতে তিনি তিবলিসে প্রধান সেনাপতি প্রিন্স ভরন্তসভকেই বুঝিয়েছিলেন।
৭
আহত আভদিয়েভকে হাসপাতালে নিয়ে সাধারণ ওয়ার্ডে একটা খালি বিছানা দেওয়া হলো। হাসপাতালটা দুর্গে ঢোকার পথে একটা কাঠের বাড়ি, ছাদটাও তক্তা দিয়ে বানানো। ওয়ার্ডে চারজন রোগী–একজনের টাইফাস, তার প্রচণ্ড জ্বর। আরেকজন দেখতে ফ্যাকাশে এবং চোখের নিচে কালি। তার ম্যালেরিয়ার মতো পালা জ্বর। সে অবিরাম গোঙাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আবার জ্বর আসবে। বাকি দুজন তিন সপ্তাহ আগের এক হামলায় আহত একজনের হাতে লেগেছিল, সে দাঁড়িয়েছিল। অন্যজনের লেগেছিল কাঁধে। সে ছিল বিছানায় বসা! টাইফাসের রোগীটা ছাড়া সবাই কাছে গিয়ে আভদিয়েভ এবং যারা তাকে নিয়ে এসেছিল, তাদের ঘিরে ধরে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করল।
কোনো কোনো সময় তারা এত গুলি করে যে মনে হবে তোমার ওপর মটরশুটি ছিটাচ্ছে, কিন্তু তাতেও কিছুই হয় না আর এবারমাত্র গোটা পাঁচেক গুলি করেছে, যারা নিয়ে এসছিল, তাদের একজন বলল।
ভাগ্যে যা আছে, প্রত্যেকের তা হবে!
আহ! বিছানায় নামানোর সময় ব্যথা সহ্য করার চেষ্টায় জোরে ককিয়ে উঠল আভদিয়েভ। নামানো হলে সে কোঁকানি থামাল এবং ভুরু কুঁচকে তার পা অনবরত নাড়াচ্ছিল। তার ক্ষতের ওপর হাত রেখে সে সোজা সামনে তাকিয়ে থাকল।
ডাক্তার এসে তাকে উপুড় করে শোয়াতে বলল, যাতে দেখতে পারে গুলি পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে কি না।
এটা কী? ডাক্তার জিজ্ঞেস করল। রোগীর পিঠ থেকে পাছা পর্যন্ত দুটো লম্বা সাদা দাগ, কাটা চিহ্নের মতো একটা আরেকটার ওপর দিয়ে গেছে।
এটা অনেক আগে হয়েছিল, স্যার! ককিয়ে জবাব দিল আভদিয়েভ।
আভদিয়েভ মদের পেছনে সব টাকা উড়িয়ে দেওয়ায় যে চাবুক খেয়েছিল, তারই দাগ ওগুলো। ডাক্তার অনেকক্ষণ তার পেটে পরীক্ষা করে গুলিটি পেল কিন্তু বের করতে পারল না। সে ক্ষতের ওপর ব্যান্ডেজ বেঁধে প্লাস্টার করে দিয়ে চলে গেল। ডাক্তারের পরীক্ষা ও ব্যান্ডেজ বাধার পুরো সময়টা আভদিয়েভ দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে ছিল। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সে চোখ খুলে অবাক হয়ে চারদিক দেখল। সে অন্য রোগীদের এবং শল্যবিদের আরদালির দিকে তাকাল শূন্য দৃষ্টিতে, কিন্তু অন্য কী একটা তাকে অবাক করে দিল।