বলতে বলতে প্রিন্স ঘরে ঢুকলেন। বুক্কাকে অবাক ও অসন্তুষ্ট করে হাঁটু থেকে নামিয়ে দিয়ে হাজি মুরাদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। তার মুখের হালকাভাব কঠিন ও গম্ভীর হয়ে যায় এবং ভরন্তসভ বসার পরই কেবল তিনি আবার বসেন।
আলাপের খেই ধরে হাজি মুরাদ মারিয়া ভাসিলিয়েভনাকে জবাব দেন যে তাদের সমাজেও বন্ধু কোনো কিছুর প্রশংসা করলে তাকে তা দিয়ে দেওয়াই নিয়ম।
আপনার ছেলে! ছোট ছেলেটির কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটি আবার তার হাঁটুতে উঠে বসেছিল।
তোমার দস্যু খুব মজার! মারিয়া ভাসিলিয়েভনা তার স্বামীকে ফরাসিতে বলল। বুক্কা তার ছোরাটা পছন্দ করেছে আর উনি সেটা ওকে দিয়ে দিয়েছেন।
বুল্কা তার বাবাকে ছোরাটা দেখাল।
এটা তো খুব দামি জিনিস! তার মা বলল।
আমাদেরও কোনো সুযোগে তাকে উপহার দিতে হবে, ভরন্তসভের জবাব।
হাজি মুরাদ চোখ বন্ধ করে ছেলেটির কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে বলছিলেন, জিগিত, জিগিত! (তাতার ভাষায় অর্থ দক্ষ সাহসী ঘোড়সওয়ার)।
সুন্দর, খুব সুন্দর ছোরা, ছোরাটার ধারালো ফলা খাপ থেকে অর্ধেক বের করে রুশ ভাষায় বললেন ভরন্তসভ। ফলাটার মাঝখানে একটা শিরা। আপনাকে ধন্যবাদ!
দোভাষীকে বললেন, জিজ্ঞেস করো আমি তার জন্য কী করতে পারি।
দোভাষী তার অর্থ বললে হাজি মুরাদ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তার কিছু দরকার নেই, শুধু নামাজ পড়ার জায়গা দেখিয়ে দিলেই হবে।
ভরন্তসভ খানসামাকে ডেকে হাজি মুরাদ যা চেয়েছে, তা-ই করতে বললেন।
তাকে দেওয়া কামরায় ঢুকে একা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজি মুরাদের চেহারা। পাল্টে গেল। কখনো বিনয়ী, কখনো গুরুগম্ভীর এবং প্রসন্নতার ছাপ উবে গিয়ে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল। হাজি মুরাদ যা ভেবেছিলেন, ভরন্তসভ তাকে তার চেয়ে ভালোভাবে বরণ করেছেন। কিন্তু ভরন্তসভ ও তার কর্মকর্তারা যত ভালো ব্যবহার করছিল হাজি মুরাদ তাদের তত কম বিশ্বাস করছিলেন। সবকিছুতেই তার শঙ্কা, তাকে গ্রেপ্তার করে শিকল বেঁধে সাইবেরিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে বা খুন করা হতে পারে এবং তাই সে হুঁশিয়ার ছিল। এলডার তার ঘরে ঢুকলে তাকে জিজ্ঞেস করলেন অন্য মুরিদদের কোথায় রাখা হয়েছে, তাদের অস্ত্র নিয়ে নিয়েছে কি না, ঘোড়াগুলোই-বা কোথায়। এলড়ার খবর দিল ঘোড়াগুলো প্রিন্সের আস্তাবলে রাখা হয়েছে, মুরিদদের একটা খামার ঘরে রাখা হয়েছে, তবে অস্ত্রগুলো তাদের কাছেই আছে, একজন দোভাষী খাবার এবং চা দিচ্ছে।
হাজি মুরাদ সন্দেহে মাথা নাড়লেন। কাপড় ছেড়ে নামাজ পড়লেন এবং এলডারকে তার রুপার ছুরিটা এনে দিতে বললেন। তারপর পোশাক পরে বেল্ট বেঁধে সোফার ওপর পা তুলে বসে ভাগ্যে কী আছে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন।
বিকেল চারটায় দোভাষী তাকে প্রিন্সের সঙ্গে খানা খেতে ডেকে নিয়ে গেল।
রাতের খাবারে তিনি প্রায় কিছুই খেলেন না, শুধু মারিয়া ভাসিলিয়েভনা নিজে থালার যে দিকটা থেকে পোলাও নিয়েছিলেন, ঠিক সেই দিক থেকে একটু পোলাও নিলেন।
সে ভয় করছে আমরা তাকে বিষ খাওয়াব, স্বামীর দিকে মন্তব্য মারিয়া। ভাসিলিয়েভনার। আমি যে-ই দিক থেকে নিয়েছি, সে-ও ঠিক সেই দিক থেকে নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দোভাষীর মাধ্যমে হাজি মুরাদকে জিজ্ঞেস করল তিনি আবার কখন নামাজ পড়বেন। হাজি মুরাদ পাঁচটা আঙুল তুলে সূর্যের দিকে ইশারা করে দেখালেন। তাহলে খুব তাড়াতাড়ি সময় হয়ে যাবে, ভরন্তসভ তার ঘড়ি বের করলে একটা স্প্রিংয়ে চাপ দিলেন। ঘড়িতে সোয়া চারটার ঘণ্টা বাজল। বোঝা গেল, হাজি মুরাদ ওটায় খুব অবাক হয়েছেন, তিনি ঘণ্টাটা আবার শোনার এবং ঘড়িটা দেখতে দেওয়ার অনুরোধ করলেন।
প্রিন্সেস তার স্বামীকে ফরাসিতে বলল, এটাই সুযোগ! তাকে ঘড়িটা দিয়ে দাও।
ভরন্তসভ সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িটা হাজি মুরাদকে দিয়ে দিলেন।
তিনি বুকে হাত রাখলেন এবং ঘড়িটা নিলেন। কয়েকবার স্পিংটায় চাপ দিয়ে ঘণ্টার আওয়াজটা শুনলেন এবং প্রশংসা করে মাথা নাড়লেন।
খাওয়া শেষ হলে কেউ একজন জানাল, মেলার-জাকোমেলস্কির এডিসি এসেছে।
এডিসি প্রিন্সকে জানাল হাজি মুরাদের আসার খবর পেয়ে জেনারেল খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কারণ, তাকে এ বিষয়ে আগে জানানো হয়নি এবং হাজি মুরাদকে কোনো দেরি না করে তার কাছে পাঠাতে বলেছেন। ভরন্তসভ জেনারেলের আদেশ মানার কথা বললেন এবং দোভাষীর মাধ্যমে হাজি মুরাদকে এই আদেশের কথা জানিয়ে তাকে মেলারের কাছে যেতে বললেন।
এডিসি কী জন্য এসেছে, শুনে মারিয়া ভাসিলিয়েভনা তক্ষুনি বুঝতে পারলেন তার স্বামী ও জেনারেলের মধ্যে এটা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে, তাই তার স্বামীর কোনো বারণ না শুনে সে এডিসি ও হাজি মুরাদের সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
(ফরাসিতে তাদের দুজনের আলাপ।)
তুমি বাড়িতে থাকলেই বেশি ভালো হবে। এটা আমার ব্যাপার, তোমার নয়।
জেনারেলের বেগম সাহেবার সঙ্গে দেখা করতে তুমি আমাকে কিছুতেই বাধা দিতে পারবে না!
(রুশ ভাষায় তাদের দুজনের কথা।)
তুমি অন্য সময় যেয়ো।
আমি এখনই যেতে চাই।
কিছুতেই ঠেকাতে না পেরে রাজি হলেন ভরন্তসভ; শেষ পর্যন্ত তারা তিনজনই গেলেন।
তারা ঘরে ঢুকলে মেলার গম্ভীর অথচ ভদ্রভাবে মারিয়া ভাসিলিয়েভনাকে তার স্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলেন এবং এডিসিকে বললেন হাজি মুরাদকে অপেক্ষা করার ঘরে বসাতে এবং আবার আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাকে যেন বাইরে যেতে না দেয়।